বিপ্লব বিশ্বাস
ছত্রিশ হাজার লাইন কবিতা লিখে দুর্মর অতৃপ্তির কথা অকপটে ব্যক্ত করেছিলেন যে মাটিগন্ধী মানুষটি সেই বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৯২০ -১৯৮৫) জন্মশতবর্ষপূর্তি হল গত ০২.০৯.২০২০ তারিখে। বড় বড় প্রকাশন সংস্থার দ্বারস্থ না হয়েও তিনি যে আমপাঠকের নজরকাড়া শ্রদ্ধা পেয়েছেন তা বলাই বাহুল্য। তিনি ছিলেন ক্ষুদ্র (নেতিবাচক অর্থে নয়) কাগজের বৃহৎ কবি। যাই হোক, সামান্য হলেও তাঁর যে কিছু গদ্যসম্ভার আছে, বিশেষত কয়েকটি গল্প তা হয়তো অনেকেরই জানা নেই বা কবি বীরেন্দ্রর দাপটে তা চাপা পড়ে গেছে। তিনি প্রয়াত হন ১৯৮৫ সালের ১১ জুলাই। তাঁর প্রয়াণ-স্মরণে দৈনিক বসুমতীতে ২৮.৭.৮৫ তারিখে প্রাবন্ধিক অজয় নাগ লিখেছিলেন: (বীরেন্দ্র) আশ্চর্য সুন্দর গল্প লিখেছেন প্রায় পনের-ষোলটা। গল্পগুলোতে স্বচ্ছ কল্পনার ছবির তলায় বক্তব্যের শরীর দেখা যায়।’ যদিও গল্প-সংখ্যা বিষয়ে এই তথ্য সঠিক নয় বলেই আমাকে জানিয়েছেন বীরেন্দ্রকন্যা মিত্রা ঘোষ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর তথ্যানুযায়ী বীরেন্দ্রর গল্পসংখ্যা পাঁচ-ছটির বেশি নয় যদিও সবগুলির হদিস আমি এখনও পাইনি। আমার কাছে তাঁর একটিই মাত্র গল্প আছে যা সুব্রত রুদ্র সম্পাদিত ‘ কবির গল্প ‘ বইটি থেকে আহৃত এবং যে গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৭১ বঙ্গাব্দের আষাঢ় সংখ্যার ( ১৯৬৪ সাল) ‘ অগ্রণী ‘ পত্রিকায়। গল্পের নাম ‘ অন্ধকারের অন্তরে ‘।
আমার এখনকার আলোচনীয় গল্প এটিই যেখানে তাঁর কাব্যগত ধ্যান-ধারণার সাযুজ্য প্রতীয়মান হয়। ১৯৮৭ সালে ‘বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্মারক বক্তৃতা’ য় প্রাবন্ধিক সুমিতা চক্রবর্তী বলেছিলেন, ‘ জীবনের শেষ দুই দশকে বীরেন্দ্র-কাব্যবিষয়ের মধ্যে প্রধান হয়ে উঠেছিল এই দেশ, এই প্রশাসন ও ‘ বৃহত্তম গণতন্ত্র ‘ নামে কথিত এই ভূখণ্ডের নির্যাতিত মানুষদের কথা।’ তাঁর এই বক্তৃতায় তিনি আরও বলেছিলেন, ‘কবির ভাষা যদি হয় বেশি ঘোরানো বা অতিমাত্রায় ইঙ্গিতে ব্যক্ত বা অধিকমাত্রায় বিমূর্ত-তা আলোড়িত করতে পারে না গণপাঠকের বোধকে।’ বীরেন্দ্রর কবিতা সম্পর্কে এ কথা প্রযোজ্য হলেও বর্তমান গল্পটি কিন্তু বক্রভাষ্যের চাবুক।
এ বার গল্পটির আলোচনায় প্রবেশ করি। মোট পাঁচটি ভাগে বিভক্ত এই গল্পে কী নেই, কে নেই! শুরু বাতাস, পাতা, সাপ, ইঁদুর, পিঁপড়েদের দিয়ে; শেষ, আপাতশক্তিমান অথচ দুর্বল, ক্ষমতাহীন ঈশ্বরকে দিয়ে-তাঁর সঙ্গে মুখোমুখি বসে, অসহায়তাকে ছুঁয়ে। শুরুতেই মনে হতে পারে, কবির লেখা কাব্যিক সূচনায় এ গল্প কিশোরবয়সীদের জন্য যেখানে অসুস্থ অমল আছে, বিদ্যাসাগরীয় মাসির কান কামড়ানো ভুবন আছে; আছে বাঘের গলায় হাড় ফোটার গল্প আর সারসের উপকারের বোকা-কাহিনি। কিন্তু এ সবের পরতে পরতে যা আছে সেটাই বীরেন্দ্রর জীবনদর্শন; নিয়ত কলমিক অস্ত্রোপচারও বটে, খুব সূক্ষ্ম চালনায় তিনি যে রক্তরেখা টেনে গেছেন তা তীব্রতায় সঘন, তীক্ষ্ণতায় চরম আক্রমণাত্মক, ঠিক ব্রিটিশ লেখক ভি এস প্রিচেটের গল্পবৈশিষ্ট্য অনুযায়ী।
কিন্তু গল্পটি কার? কে আছে গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে যার কথন-বয়ান এমন নানাবিধ আক্রমণের সূচিমুখ হয়ে ওঠে? সে এক অসুস্থজন যে ‘ডাকঘর ‘-এর অমলের চাইতে দ্বিগুণ বা তিনগুণ বয়সী হতে পারে। সে বন্দি থাকে একচিলতে ঘরে যেখানে নানা চরিত্রের সমাবেশ, সমারোহ। কেউ তাকে কষ্ট দেয়, কেউ দেয় উসকানি। মনুষ্যচরিত্র হিসেবে তার মা ও দাদার সামান্য উল্লেখ থাকলেও তারা তেমনভাবে জায়গা দখল করে থাকে না। আর আছে এক ডাক্তার যে তার চিকিৎসা করলেও ভেজাল ওষুধ দিতে নারাজ। আবার দামি খাঁটি ওষুধ কেনার সামর্থ্যও নেই বক্তা রোগীর। সেই ডাক্তার তার অসুস্থতাকে অনাহারজনিত লিখতেও নারাজ। বলে, নিউমোনিয়া।
যাই হোক, গল্প শুরু হয় বাতাসের বেয়াদবি দিয়ে। সে উত্তর দিক থেকে ধেয়ে এসে রোগীর শীত ধরিয়ে দেয় অথচ সেও অসহায়, নাচার। তাই সে বলে, ‘ আমাকে চাকরী করতে হয়। এখন আমি কিছুতেই অন্য দিক থেকে বইতে পারব না।’ এ যেন সমস্ত চাকরিজীবীদের অনিচ্ছুক দায়ের কথা। উত্তুরে বাতাসে গাছের বিবর্ণ পাতা ঝরে গেলে পাতার সঙ্গে বাতাসের ঝগড়া বেধে যায় যা বক্তা-রোগীর খারাপ লাগে। সে পাতাদের অন্যভাবে দেখতে চায়। তাদের মুখ তো সব সময় আলোর দিকে। এমনই ইতিবাচকতা নিয়ে ধ্বংসের মাঝে নির্মাণের রূপকার হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন গল্পকার বীরেন্দ্র।
রোগীর বুকে অসহ্য যন্ত্রণা। ভেতরে যেন অজস্র ম্যাগটরূপী জীবাণু সর্বদা দাবড়ে বেড়াচ্ছে। তবুও ডাক্তার কমদামি দেশি ওষুধ প্রেসক্রাইব করবে না। সে সব নাকি ভেজাল। তাই সে বিদেশি দামি ওষুধ লিখে দেয় যা আবার কেনার ক্ষমতা রোগীর নেই। বীরেন্দ্র এখানে ভেজালের বিরুদ্ধে সরব না হলেও দেশে তার গেঁড়ে বসাকে প্রকট করেন। কেননা তিনিই লিখেছিলেন ‘ ভেজাল মেশানো রুটি’র কথা। এরমধ্যে সাপ, ইঁদুর, পিঁপড়েরা ওকে ভাইস প্রেসিডেন্ট বানিয়ে সভা করতে উদ্যত হয়; ওরা মিছিল বের করছে, অবশ্য কী বিষয়, জানার উপায় নেই-যেমনটা অনেক সময় বাস্তবত হয়ে থাকে। অনেকটা উত্তেজনার আগুন পোহানোর মতো। রোগী জানিয়েছে, সেও পোকাদের বিরুদ্ধে, তাদের নোংরামির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে অনশন করতে চায়। ছত্রিশ ঘন্টার ( ‘ ছত্রিশ ‘ সম্ভবত বীরেন্দ্রর প্রিয় শব্দ)।
যাই হোক, ইঁদুরেরা অর্থাৎ যারা নিচুতলার, যারা অনশন ধর্মঘট করলেও যা খবর হয় না, তারা ওকে সহ-সভাপতি করেছে কেননা সেই একমাত্র সাহিত্যিক যার নিউমোনিয়া হয়েছে। আবার পোকারা তাকে মেরে ফেললেও তাদের চিন্তা নেই কেননা তারা নতুন ভাইস প্রেসিডেন্ট ঠিক করে রেখেছে। এরমধ্যে ডাক্তার কিছু মজার কথা শোনায়; শোনায় কিছু পক্ষপাতমূলক যুক্তির কথা। তার মতে রোগী যে সঠিক ওষুধটি খেয়েই সুস্থ হয়, বেঁচে ওঠে তা ঠিক নয়। বেঁচে ওঠে শুধু ভেজাল ওষুধ খায় না বলে। এখানে ডাক্তারের চিকিৎসা বিষয়ক অসার জ্ঞানের প্রতি বিদ্রুপ হেনেছেন গল্পকার। আবার সরকারি ডাক্তারদের সরকারকে বাঁচানোর বাধ্যবাধকতাও আছে। ‘ অনাহারে মৃত্যু’, ‘ঔষধের ভেজালজনিত কারণে মৃত্যু’ কিংবা ‘ ঔষধের অভাবে মৃত্যু ‘ – এ সব কথা তারা সার্টিফিকেটে লিখতে পারবে না, পারে না। তাতে সরকার বিপন্ন হতে পারে। সম্প্রতি কোভিড ১৯ জনিত মৃত্যুসংখ্যা বা কো-মর্বিডিটিজনিত বিবাদ নিয়েও এমন তরজা আমরা লক্ষ করলাম। তাই এখানেও ডাক্তারকে রোগীর নিউমোনিয়ার মিথ্যে কথাই লিখতে হয় যা সরকারিভাবে নিরাপদ বিধান।
এরপর ‘ ডাকঘর ‘-এর অমলের বিষয়ে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে বীরেন্দ্র পরিষ্কার বলেন, একটা অসুস্থ ছোটো ছেলেকে সবাই মিলে নিয়ত মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে ঠকিয়েছে। তাকে খুশি করতে গিয়ে বাচ্চা বলে ঠকাতে পেরেছে কিন্তু এই তাকে তা করা যাবে না। সে অমলের চেয়ে অনেকটাই বড়। সে ‘ ডাকঘর ‘ পড়েছে। সে ঠকবে না। বিচ্ছিন্ন ভাবনার ঢঙে তাঁর মনে পড়ে মন্ত্রীদের কথা যাদের জন্য ডাক্তারকে মিথ্যে সার্টিফিকেট দিতে হয়, কেননা তারা অনেক কষ্ট করে মন্ত্রী হয়েছে, তাদের ঈশ্বরের মতো আলাদা সম্মান থাকা উচিত। তারা কোনও খারাপ কাজ করতে পারে না। পোকাগুলো যেমন রোগীর বুকে বসে রক্তপান করছে মন্ত্রীরাও তেমন সমস্ত দেশের বুকে চেপে দেশ-মায়ের রক্তপান করছে।
গল্পের মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রীদের প্রতি এমন ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের কশাঘাত বীরেন্দ্র প্রচুর হেনেছেন তাঁর কাব্যসম্ভারে। ‘ ইতর মন্ত্রী ‘ বলতেও দ্বিধা করেননি। তিনি এখানেও বলেন, ‘মন্ত্রীদের জন্য আমাকে অনেক ভাবতে হয়। সে জন্যই ঘুম আসে না।’ ভুবন আর তার মাসির কান কামড়ানোর গল্পটির উল্লেখ করে তিনি বোঝাতে চান, চুরিই যদি না থাকত তাহলে দেশে এত মন্ত্রী গজাচ্ছে কী করে? আবার এ কথার পরেই বলছেন, ‘এসব ব্যাপারে আমার মাথা ঘামানো উচিত হবে না। এতে করে সরকারী পেনসনটাই নষ্ট হবে। তাছাড়া, আজকাল সাহিত্যে অনেক পুরস্কার দেওয়া হয়।’ এ বয়ান শুনে আমাদের ‘সুশীল সমাজ ‘-এর কথা মনে পড়ে যায় যাঁরা প্রতিবাদটাও করেন বেছেকুছে, মেপেজুকে- কিছু প্রাপ্তির আশায়।
বাঘ-সারসের নীতিগল্পের বিষয়টিও তাঁর নজর এড়ায় না। তাঁর মতে, সারস নির্বোধ। তাই সে বাঘের গলা থেকে হাড় বের করে দিয়েছিল। কেননা সারস বাঘের খাদ্য। সে যে সারসকে বাগে পেয়েও ছেড়ে দেবে, এ কথা তিনি বিশ্বাস করতে চান না। সিংহ হলেও না হয় কথা ছিল, কেননা সব সিংহ নরখাদক হয় না। প্রসঙ্গক্রমে একবার সিংহ যে এক ক্রীতদাসকে ছেড়ে দিয়েছিল তার উল্লেখে এ কথা বলেন তিনি। এ ভাবেই তিনি যখন মন্ত্রীদের ছেড়ে কলমচিদের ধরেন, সেখানেও ছড়িয়ে দেন উচাটন ঘৃণা, ব্যঙ্গের ছলে। সাহিত্যিকরা অসুস্থতার ভান করে সরকারি পেনশনের আশায় থাকে, ঘনঘন সরকারি দাক্ষিণ্যে বিদেশে যায়-এ সব যে তিনি গল্পে বলছেন তাই নয়, বাস্তব চিত্রপটও তদ্রূপ। এ জন্য তাঁর মতো অক্ষমকেই পোকামাকড়দের (দুর্বল কলমচি) ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়ে থাকতে হয় কেননা পিঁপড়েরা তাঁকে বুঝিয়ে দেয়, ‘ অন্য সাহিত্যিক পেলে তো? এখন সবাই রাশিয়া অথবা আমেরিকায় যাচ্ছে। তোমার মতো কেউ বসে নেই।’ আবার সাহিত্যজগতের কোন্দলের প্রতি ইঙ্গিত করতেও ছাড়েননি তিনি। তাই বলছেন, ‘ সাপ আর ইঁদুর ( পারস্পরিক শত্রুভাবাপন্ন) একসঙ্গে সভা করছে, এটা কেউ সুস্থ মাথায় কল্পনা করতে পারে?’ আবার পিঁপড়েরূপী সাহিত্যিকরাও ভয়ংকর; তারা সাম্য-মৈত্রী এ সব বিশ্বাস করে না। তাদের একটাই চিন্তা, ‘ রাণীকে কি করে বাগানো যায়।’ সুতরাং ইঁদুরদের সভায় পিঁপড়েদেরও আর ডাকা হবে না।
সাহিত্য তথা রাজনীতির জগতে এমত খাওয়াখাওয়ির বিষয় সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞজনেরা ভালোই টের পান। এক নিম্নগামী স্তরে নেমে সাহিত্য আর রাজনীতির যে অশুভ মেলবন্ধন ঘটে তারও উল্লেখ করতে ছাড়েন না গল্পকার যখন পোকামাকড়দের একই দিনে দুটো সভার আয়োজনের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি স্পষ্ট বলেন, ‘ তারা সাহিত্য ও সংস্কৃতির মাত্রা লঙ্ঘন করছে। সমস্ত ব্যাপারটাই রাজনীতির দিকে এগুচ্ছে। ‘ তিনিই তো এক সময় বলেছিলেন, ‘ কবি আজ বেশ্যার সমান।’
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে যে কোনও প্রতিক্রিয়াশীল চেহারাই বিষয়বস্তু হয়ে ধরা দিয়েছে। যা তার কাছে অমানবিক বলে মনে হয়েছে তখনই তাকে তীব্র কশাঘাতে ফালাফালা করেছেন। সংর্ধনাসভা, পুরস্কার প্রদান ইত্যাদি আলগা লোকাচার আমরা যতই দেখাই না কেন, প্রকৃত অর্থে আমরা কেউই আজও পরিশুদ্ধ হতে পারিনি। আবার দেখা যাচ্ছে, সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার ললিত বাণীও যে হাস্যাস্পদ হয়ে পড়েছে তাও তাঁর দৃষ্টির বাইরে থাকে না। একই সাম্যবাদে বিশ্বাসী বড়লোক আর গরিব দেশের মধ্যে যে খেয়োখেয়ি সম্পর্ক তারও উল্লেখ করেন তিনি। গল্পচ্ছলে বলেন যে, তিনিও সাম্যবাদী, তাঁর প্রতিবেশীও তাই। তিনি গরিব, প্রতিবেশী ধনী। অথচ তাঁর এই অর্থাভাবে তাঁকে তারা ওষুধের জোগান দিচ্ছে না। দিলে হয়তো তিনি তার আরব্ধ উপন্যাসটি শেষ করতে পারতেন। আবার তিনি এ ব্যঙ্গপূর্ণ ইশারা করতেও ছাড়ছেন না যে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে পোকামাকড়ের দল তাঁর বাড়িতে সভা করতে আসে শুধু এটা ওটা খাবার লোভে। এ ঘটনাও বাস্তবের দৈনন্দিনতায় লুক্কায়িত নয়।
এত সব অসহায়তা, ক্লেশের মাঝে শেষ পর্যায়ে তিনি সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের কথা ভাবতে থাকেন যাঁকেও মানুষ যথেষ্ট মর্যাদা দিচ্ছে না। তিনি ঈশ্বরের প্রতিভূ অর্থাৎ যারা তাঁর ঠিকাদার হয়ে বসে আছে তাদের বিরুদ্ধে পরিষ্কার বিদ্রোহ করে বলছেন : ‘ বেচারাকে (ঈশ্বরকে) আমরা অনেকদিন ক্লাসের বাইরে নিলডাউন করিয়ে রেখেছি। অথচ তার কোনো দোষ ছিল না। দোষ যা, সে তো পুরুত, মোল্লা আর পাদ্রীদের। সেজন্য ঈশ্বরকে আমরা শাস্তি দেব কেন? ‘
এখানে আবার সুমিতা চক্রবর্তীর বক্তব্যে ফিরতে হয় যেখানে কবি বীরেন্দ্র সম্পর্কে তিনি বলছেন, ‘ঈশ্বরের নাম তাঁর কবিতায় এত গভীরতার সঙ্গে বারবার উচ্চারিত হয়েছে যে মার্কসবাদে বিশ্বাসী তাঁর বহু অনুরাগী অস্বস্তি বোধ করেছেন অনেক সময়।… অবশ্য কবিতার প্রয়োজনে এসেছে ঈশ্বর প্রসঙ্গ, ভক্তের বিশ্বাসের সূত্রে নয়।’ যাইহোক, এখন তিনি ঈশ্বরের সম্মুখীন যাঁর মাথায় গাধার টুপি। বক্তা-রোগী তাঁকে একটিবার দেখতে চেয়েছিল। তিনি মাস্টারমশাইয়ের কাছে শাস্তি পেয়ে এসেছেন। রোগী অবাক হয়ে জানতে চায়, ‘ তুমি কি এখনো স্কুলে পড়ছ নাকি? ‘ ঈশ্বর বলেন, ‘ তাছাড়া কি? স্কুল থেকে কোনদিন বেরুব, মানুষ কি তার ব্যবস্থা রেখেছে? ‘ মানুষের ওপর ঈশ্বর নির্ভরশীল কেন, এ প্রশ্নে সে চিন্তিত হলে ঈশ্বর বলেন, ‘ একমাত্র মানুষই বই লেখে। তার কথামতোই পৃথিবীর সব কিছুর স্বরূপ ঠিক হচ্ছে। আমিই বা বাদ যাব কেন? ‘ বড় মোক্ষম কথা যার প্রকাশ আমরা এখন আরও ঘৃণ্য ঢঙে প্রকট হতে দেখছি আমাদের চারপাশে। মানুষ ঈশ্বরকে শিখণ্ডী করে মতলব হাসিল করে আবার তাঁকে কাঠগড়ায় তুলতেও কসুর করে না।
এত সব কথার পর ঈশ্বর আর সে চুপচাপ বসে থাকে। মুখোমুখি। তাকে সুস্থতা দেবার ব্যাপারে অসহায় ঈশ্বরের কোনও হাত নেই, করার নেই কোনও কিছু। গল্প শেষ হয়। এ গল্পের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে, জড়িয়ে আছে প্রভবিষ্ণু বীরেন্দ্র-দর্শন; তাঁর প্রতিবাদী মানসিকতার প্রায় সবটাই যা আমরা তাঁর কবিতার অন্দরে প্রতিনিয়ত পাই। তাই শেষ করি তাঁর একটি শ্লেষাত্মক ছড়ারূপী কবিতা দিয়ে :
‘আয় বৃষ্টি হেনে মন্ত্রী দেব কিনে
রাজার থেকে সস্তা, এক পয়সায় দশটা।
“কটা মন্ত্রী কিনলি বাছা?”
“তিনটে পাকা, সাতটা কাঁচা।”
মন্ত্রী পড়ে টুপটাপ
সোনা গেলে গুপগাপ্। ‘
তথ্যসূত্র ১) কবির গল্প – সুব্রত রুদ্র সম্পাদিত / পত্রলেখা।
২) দৈনিক বসুমতী / ২৮.৭.১৯৮৫
৩) কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্মারক বক্তৃতা : ১৯৮৭ / সুমিতা চক্রবর্তী।
৪) বীরেন্দ্র সমগ্র / অনুষ্টুপ।
৫)’ বনামি’তে ( ফেব্রুয়ারি, ১৯৯২) প্রকাশিত আমার প্রবন্ধ ‘ শেষের কথা, শাশ্বত শুরুর কথা ‘।
(বিপ্লব বিশ্বাস গল্পকার, অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক)
(ফিচার ছবিটি গুগল থেকে নেওয়া)