দীপক সাহা

কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচী ১৩১২ বঙ্গাব্দে সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘পল্লি-কথা’ প্রবন্ধে করিমপুর ও তৎসংলগ্ন এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে লিখেছেন, “এ অঞ্চলে রাস্তাঘাটের একান্ত দুরবস্থা। ১৮৮৫ সালে প্রথম ‘লোকাল বোর্ড’ স্থাপিত হয়; সেই সময় হইতে অল্পে অল্পে এই বিষয়ের কিঞ্চিৎ উন্নতি দেখা যাইতেছে। ‘লোকালবোর্ড’ কৃত প্রধান রাস্তা এখানে ‘সরাণ’ নামে অভিহিত। এখানকার বড় সরাণ জলঙ্গী হইতে কৃষ্ণনগর পথে কলিকাতা গিয়াছে।” এই প্রবন্ধে কবি আরও উল্লেখ করেছেন, “এক্ষণে বারো ক্রোশ দূরে ভেড়ামারা নামক স্থানে স্টেশন হইয়াছে; ইহা এক্ষণে নিকটতম স্টেশন।”

দেশভাগ ও বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পরে নদিয়া জেলার আয়তন, সীমারেখা ও আর্থ-সামাজিক অবস্থা আমূল বদলে গিয়েছে। সেই সঙ্গে সীমান্তবর্তী এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থারও পরিবর্তন হয়েছে। দেশভাগের আগে কিছুদিনের জন্য মহকুমা শিরোপার অধিকারী করিমপুর বর্তমানে নদিয়া জেলার অন্যতম বিধানসভা কেন্দ্র, থানা এবং সীমান্ত শহর যা বর্তমানে তেহট্ট মহকুমার অন্তর্গত। জেলা সদর শহর কৃষ্ণনগরের সঙ্গে সড়কপথে ১১ নম্বর রাজ্য সড়ক দ্বারা যুক্ত। দূরত্ব ৭৯ কিলোমিটার। দেশভাগের আগে করিমপুর থেকে ভেড়ামারা রেলস্টেশনের দূরত্ব ছিল প্রায় ৩৬ কিমি। বর্তমানে করিমপুর থেকে কৃষ্ণনগর রেলস্টেশনের দূরত্ব প্রায় আশি কিমি। সেই প্রাইমারিবেলা থেকে শুনে আসছি, করিমপুর-কৃষ্ণনগর রেলপথ হবে। আমার বাপ-ঠাকুর্দাও এই একই কথা শুনে শুনে ইহলোক ত্যাগ করেছেন। এ দিকে, জলঙ্গি নদী ক্রমশ শীর্ণ থেকে শীর্ণতর হয়েছে। বিভিন্ন সংগঠন নানা সময়ে দাবিদাওয়া পেশ করেছে, আন্দোলন করেছে। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা।

বাজারে চায়ের দোকানে বা লোকসভায় গরমাগরম তর্কবিতর্ক হয়। কিন্তু বাস্তবে, এলাকায় উৎসব বা অনুষ্ঠান উপলক্ষে বিভিন্ন মেলায় আসা মডেল রেলগাড়ি চড়েই করিমপুরের সাধারণ মানুষ দুধের স্বাদ ঘোলে মেটান। তাই রেলপথ না থাকায় ১১ নম্বর রাজ্য সড়কই করিমপুর, তেহট্ট, পলাশিপাড়ার এলাকার মানুষের একমাত্র যাতায়াতের ভরসা। জেলার তেহট্ট মহকুমার পাঁচটি থানা ও চাপড়া থানা মিলিয়ে কয়েক লক্ষ মানুষ এই সড়ক দিয়ে যাতায়াত করেন। এছাড়াও মুর্শিদাবাদ জেলা থেকে অনেক যানবাহন এই সড়ক দিয়ে যাতায়াত করে। করিমপুর থেকে কৃষ্ণনগরের রাস্তায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত হাম্প। রাজ্যের কোনও রাস্তায় এত সংখ্যায় হাম্প আপনি দেখতে পাবেন না। এই রাস্তায় যেতে বেশিরভাগ যাত্রীর চোখে জল এসে যায়। এই রাস্তায় প্রায় আড়াইশো যাত্রীবাহী বাস, পণ্যবোঝাই ট্রাক, ছোট গাড়ি ও অ্যাম্বুল্যান্স কৃষ্ণনগরে যাতায়াত করে। এতগুলো হাম্প পেরিয়ে যাওয়া যেমন কষ্টকর, তেমনি সময়ও বেশি লাগে। যে কারণে নিত্য যাত্রীদের পাশাপাশি অনেক যাত্রী ও রোগী বিপদে পড়েন। যানজট হচ্ছে, বাড়ছে পথ দুর্ঘটনায় মৃত ও জখমের সংখ্যা।

কলকাতা থেকে প্রায় ২০০ কিমি দূরে করিমপুর এলাকায় চিকিৎসা পরিষেবা কহতব্য নয়। ব্লাড ব্যাঙ্ক নেই। বেশিরভাগ প্রসূতি বা দুর্ঘটনাজনিত রোগীকে ৮০ কিমি দূরে রেফার করা হয় জেলা সদরে। খবরে প্রকাশ, বছর দুই আগে করিমপুরের বাজিতপুরের একজন প্রসূতি প্রসব যন্ত্রণা নিয়ে করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতাল থেকে রেফার হয়ে কৃষ্ণনগর সদর হাসপাতালে যাওয়ার সময় চাপড়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। অতিরিক্ত ঝাঁকুনিতে হাসপাতালে পৌঁছনোর আগে পথেই তিনি সন্তানের জন্ম দেন।

করিমপুর- কৃষ্ণনগর বাস রুট ভেন্টিলেশনে যাওয়ার মুখে। এই রাজ্য সড়ক জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম রাস্তা। আপনি এই আশি কিমি রাস্তা পাড়ি দেওয়ার আগে অবশ্যই কোনও পেইন বাম সঙ্গে নিয়ে যাবেন। নইলে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে আপনি কোমর সোজা করে হাঁটতে পারবেন কিনা সে ব্যাপারে গ্যারান্টি দেওয়া যাবে না। হেলতে, দুলতে বাস চলে। রাস্তা দখল করে ইট, কাঠ, বালি, পাথর, বাঁশের ব্যবসা রমরমিয়ে চলছে। হাট-বাজার উঠে এসেছে রাস্তায়। এমনকি কিছু কিছু জায়গায় রাস্তাই যেন অনেকের বাড়ির উঠোন। করিমপুর, নাজিরপুর, বেতাই, তেহট্ট, চাপড়া ও আরও অনেক জায়গায় ফুটপাত দখল করে প্রশাসনের নীরব প্রশ্রয়ে দোকান গজিয়ে উঠেছে। এই রাজ্য সড়কে যানবাহনের আধিক্য বাড়লেও রাস্তার পরিসর সেই অনুপাতে বাড়েনি। এই রাস্তা যানবাহন বহন করার ক্ষমতা ক্রমশ হারিয়ে ফেলছে। সঠিক সময়ে গন্তব্যস্থলে পৌঁছানো যায় না।

শুধু ব্যবসা বাণিজ্য নয়, ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক শিক্ষিকা ও নিত্য অফিসযাত্রীরা প্রাণ হাতে নিয়ে যাতায়াত করেন। ট্রেন রুট না থাকা এবং বাসরুটের বেহাল অবস্থার জন্য কলকাতা, কৃষ্ণনগর থেকে বহু চিকিৎসক করিমপুরে আসতে চান না। যোগাযোগের দুরবস্থার জন্য করিমপুর এলাকায় বিবাহ সম্পর্ক স্থাপনেও অনেকে মুখ ঘুরিয়ে নেন। অতি নিম্নমানের যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে করিমপুর এলাকা সাংস্কৃতিকভাবে পুষ্ট হওয়া সত্ত্বেও এই অঞ্চলের প্রতিভা বাইরের জগতে বিকশিত হতে যথেষ্ট বাধার সম্মুখীন হয়। পাট, আনাজ ও পান চাষে যথেষ্ট উন্নত হওয়া সত্ত্বেও দুর্বল যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য এলাকার চাষিরা দূরবর্তী স্থানে তাঁদের কাঁচামাল পাঠাতে পারেন না। ফসলের উপযুক্ত মূল্য থেকে তাঁরা বঞ্চিত হন।

সোনালি চর্তুভুজ পরিকল্পনা দেশের চার প্রান্তকে এক সুতোয় বাঁধার চেষ্টা ছিল। প্রথম এনডিএ আমলে সে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছিল। পরে এনডিএ-র দ্বিতীয় ইনিংসে দেশের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলিকে চার লেনের রাস্তা দিয়ে জুড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। যার পোশাকি নাম—‘ভারতমালা’। ওই প্রকল্পের অধীনে মুর্শিদাবাদ, নদিয়া ও উত্তর চব্বিশ পরগনার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকাগুলিকে জুড়ে ৩২৯ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি হওয়ার কথা। তৎকালীন জেলাশাসক বিজয় ভারতী বলেছিলেন, “নদিয়ায় করিমপুরের গোপালপুরঘাট থেকে দত্তফুলিয়া পর্যন্ত ১২২ কিলোমিটার রাস্তাকে ভারতমালা প্রকল্পের অধীনে চার লেন করা হবে।’’ দুই দিকের লেনে ১১ মিটার করে চওড়া রাস্তা হবে। মাঝে পাঁচ মিটার বরাদ্দ থাকবে ডিভাইডারের জন্য। তাপ্পি মারা, ঢেউ খেলানো রাস্তা কবে চওড়া হয় সেই আশাতেই বুক বেঁধেছিল সীমান্ত। কিন্তু বর্তমানে সেই আশায় জল।

মানব সভ্যতায় চাকা আবিষ্কার এক যুগান্তকারী ঘটনা। তারপর থেকেই মানবজাতির অগ্রযাত্রায় অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর একটি অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর সার্বিক উন্নতি নির্ভর করে। কৃষ্ণনগরের পরে করিমপুর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা কৃষিপ্রধান। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশাসন প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে করিমপুর এলাকার মানুষদের কৃষ্ণনগর, কলকাতা যেতে হয় প্রায়ই। ভারতের এই প্রত্যন্ত অঞ্চল স্বাধীনতার পর থেকেই বঞ্চিত বিভিন্ন ক্ষেত্রে। অনেকবার রেল সার্ভে হয়েছে কিন্তু এলাকার মানুষ আজও রেল পরিষেবা থেকে বঞ্চিত। ভোট আসলেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে করিমপুর-কৃষ্ণনগর রেলপথ। রাজনীতির কারবারিরা আবারও প্রতিশ্রুতির রেলগাড়ি ছোটান। ছাগলের তৃতীয় সন্তানের মতো আমরা লাফালাফি করি। কিন্তু আখেরে কিছুই লাভ হয় না। কিন্তু ভোট বৈতরণী পার হলেই পুনঃ মুষিক ভব।

একরাশ হতাশা, অভিমান, ক্ষোভ বুদবুদ হয়ে মনের আঙিনায় হারিয়ে যায়। দেশের একপ্রান্তে বুলেট ট্রেন চালু হতে চলেছে আর অন্য প্রান্ত সেই তিমিরেই আছে। বৈষম্যের চরম চিত্র স্পষ্ট। করিমপুর বিধানসভার অন্তর্ভুক্ত ধোড়াদহে জন্মগ্রহণ করেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী ড. নলিনাক্ষ সান্যাল। ড. সান্যাল ভারতের রেলবোর্ডের উচ্চপদে আসীন ছিলেন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েও যোগাযোগ ব্যবস্থার কোনও উন্নতি হল না এখনও। দুর্ভাগ্য করিমপুর-কৃষ্ণনগরের যোগাযোগ ব্যবস্থার রিপোর্ট কার্ড মানত্য পায় না। আবার একটা ভোট উৎসব সামনে। আবার নতুন প্রতিশ্রুতি, নতুন আশা, নতুন ভরসা। তারপরেও আশায় বাঁচে চাষা।

(মতামত লেখকের বক্তিগত। ছবি গুগল ম্য়াপ থেকে নেওয়া)