সৈকত কুণ্ডু
কিছু কিছু মানুষ থাকেন, যাঁরা প্রকৃতিতে গাছের মতন। মাটির খুব গভীরে শিকড় ছড়িয়ে নিজের জন্য প্রয়োজনীয় জীবন-রস সংগ্রহ করে নেন তাঁরা; লেখাপড়া আর খোলা-মন রোদ আর বাতাস হয়ে পাতায় ঝলমল করে, বেঁচে থাকার স্পন্দন ফুল আর ফল হয়ে পরিণতি পায়।
একটু একটু করে বড় হয় গাছটা। একা একাই। সকলের চোখের সামনে কিন্তু অলক্ষ্যে। গাছ যত বড়ো হয়, মাটিতে তার ছায়া পড়ে তত বেশি করে। সে ছায়ায় কারণে-অকারণে দু’দশটা লোক এসে বসে। কেউ দু’দণ্ড জিরিয়ে যায়, কেউ বা ক্লান্তি মুছে নতুন করে পথ হাঁটার শক্তি কুড়িয়ে নেয় ছায়ার কাছে।
গাছ যে খুব বেশি নড়ে-চড়ে, কথা বলে এমন নয়। গাছ পথিকের গায়ের ওপর হামলিয়েও পড়ে না, তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেও বলে না। তবু যে যতদূরই হাঁটুক, ওই ছায়াটুকুর মধ্যে গাছটাকে সে মনে মনে বহন করে চলে।
ফুল ফোটানো শেষ হলে গাছ মন দেয় ফল ধরানোর দিকে। ফলগুলোর ছোট ছোট বীজ কখনও হাওয়ায় ভেসে, পাখপাখালির গানে আশেপাশে, অনেক দূরেও ছড়িয়ে পড়ে। তার থেকে একটা দুটো করে নতুন গাছও তৈরি হয় কখনও কখনও। বুড়ো গাছটা নুয়ে পড়ে তাদের দ্যাখে।
মানুষের যেমন ধর্ম, অনেকদিনের গাছকে আশ্রয় ভেবে বসা; সেভাবেই গাছের নামে হয়তো চিহ্নিত হয়ে যায় পথের কোনও মোড়, কোনও জায়গার নাম, অন্য কারও পরিচয়। একা দাঁড়ানো গাছটা খেয়ালই করে না, একলা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে সে নিজেই কখন যেন একটা ইনস্টিটিউশন হয়ে গেছে, মাটির উপর তার ছায়া ছড়িয়ে পড়ছে তার শিকড়ের চেয়েও বহুগুণ বেশি।
আমি মাস্টারমশাই শ্রী সুধীর চক্রবর্তীকে এই গাছটার মতো চিনি। চেনার বয়স গত একান্ন বছর। আক্ষরিক অর্থেই নিরাবরণ অবস্থা থেকে। তখন আমার বয়স এক এবং তাঁর পঁয়ত্রিশ। প্রতিবেশী ছিলেন তিনি; তাঁর ঘরের মধ্যে দিয়ে দৌড়ে গিয়ে লুকোচুরি খেলা আমাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ ছিল।
দ্বিতীয় চেনা ছাত্রাবস্থায়। কৃষ্ণনগর কলেজে, একাদশ শ্রেণি থেকে স্নাতক স্তর পর্যন্ত, আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র। আর শেষ চেনাটা ছাত্রদশা ঘোচার পরে তাঁর জীবনের শেষ পর্যন্ত, যেভাবে বীজ-থেকে-জাগা চারাগাছটাকে নুয়ে-পড়া গাছ আগলে রাখে। একসাথে লিখেছি আমরা; হেসেছি-কেঁদেছি-গেয়েছি-বেড়িয়েছি-সভা করেছি-দল পাকিয়েছি এবং যার যার মতো একলাও থেকেছি।
পণ্ডিত হয়েও পাণ্ডিত্য তাঁর প্রধান গুণ নয়। তাঁর যাবতীয় লেখার প্রথম সম্পদ তাঁর জীবন-রস; মাটির অনেক গভীরে, অনেক দূর পর্যন্ত শিকড় ছড়িয়ে রাখা। এমন মানুষই লোকায়ত জীবন-গান নিয়ে গবেষণা করবেন, এটাই স্বাভাবিক। হয়েছিলও তাই। জনপদাবলীই তিনি শুনিয়ে গেলেন সারাজীবন।
আমাদের কৃষ্ণনগরের একটা স্বভাবজ সরস-ভাব আছে। আর তার গোয়াড়ি-অঞ্চল হল সেই সরসতাকে মজিয়ে মজিয়ে খানদানি আড্ডায় গুরুপাক করে তোলার পীঠস্থান। সুধীরবাবুর সঙ্গে সঙ্গে এই খানদানি আড্ডার নবাবিয়ানারও শেষ হল সম্ভবত।
একটু খেয়াল করলেই ধরা পড়বে, গুরুগম্ভীর গানতত্ত্বও তিনি আলোচনা করছেন বৈঠকী মেজাজে। বিষয় গম্ভীর কিন্তু চাল লঘু; তথ্য সেখানে ভারের চেয়ে ধার হয়ে দেখা দিচ্ছে বেশি, ঠিক যেন কোনও দাদাঠাকুর, হুঁকোটা নামিয়ে রেখে, দু-দণ্ড গপ্পো করতে বসলেন।
এই যে আটপৌরে সহজিয়া ভাব, লাবণ্যময় গদ্যের তরল চলন, তথ্যের ধার অথচ রসের জোয়ার-ভাঁটা, এটাই এই পুস্তক বিমুখতার দিনেও তাঁর লেখার জনপ্রিয়তা অটুট থাকার গুপ্ত-রহস্য বলে আমার বিশ্বাস। যাঁরা জানেন, তাঁরা মানবেন, মাস্টারমশাই গান নিয়ে যত ভালো লিখতেন, নিজে গাইতেন তার চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। দীর্ঘ, দীর্ঘদিন তাঁর সান্নিধ্যে থাকার সুযোগ থেকে বলতে পারি, গান-বিষয়ক লেখাটা তাঁর সঙ্গীত প্রেমেরই বাই-প্রোডাক্ট।
“নির্জন এককের গান” বলে মাত্র তিন শব্দে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে চিনিয়ে দেওয়াটাও কিন্তু খুব সহজ কাজ ছিল না। ব্যক্তিগত ক্ষতি যা হল, তা গহনার মতো জমিয়ে রাখছি বুকের সিন্দুকে। খুব বেশি লোকের তো সেই অহঙ্কার থাকে না! আমি বরং ভাবছি শিকড় উপড়ে যাওয়া সেই গাছটার কথা, শহরের বুকের মধ্যে হাঁ-হয়ে থাকা ওই শূন্যতাটার কথা, আর সেই পথিকগুলোর কথা যাদের জন্য এই খাঁ খাঁ রোদে আর কোনও ছায়া অপেক্ষা করে থাকবে না।
(ফিচার ছবি গুগল থেকে নেওয়া)