কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্ত
আমরা ক্যালেন্ডার-নির্ভর জাতি। উপরে ও নীচে টিনমারা একটা কাগজের রোল নিয়ে বছরের শুরুতে ঘরে ফেরা আমাদের। তারপরে সেই গুটোনো রোলকে উন্মোচিত করে দেওয়ালে ঝুলিয়ে দেওয়া। সেখানেই আছে সারা বছরের ছুটি, বিয়ে, পৈতে, অন্নপ্রাশন, গৃহপ্রবেশের নির্ভুল ঠিকঠিকানা। তবে কিনা সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাঙালির বাঙালিত্ব যত কমেছে ততই তার ক্যালেন্ডার স্মার্ট হয়ে উঠেছে।
ইংরেজি বছরের শুরুতে যে সব দিনপঞ্জি প্রকাশিত হয় তার মূল লক্ষ্য থাকে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণার দিকে। বাংলা দিনপঞ্জির মতো অমাবস্যা-পূর্ণিমা-একাদশীযাপনে তত আগ্রহ নেই তার। তবে ‘অফিস-ক্যালেন্ডার’ নামধারী এক ধরনের বড়োসড়ো চেহারার দিনপঞ্জিতে অবশ্য তিথি-নক্ষত্রের কিছু ইশারা-ইঙ্গিত থাকে। ওইটুকুই সান্ত্বনা। তা না হলে বেশিরভাগ শৌখিন ক্যালেন্ডার মাত্রই শুধু তারিখ ও বারের যুগলবন্দি। অবশ্য এর সঙ্গে বলতে হবে ছবির আবেদনের কথাও। ক্যালেন্ডারে সেই তো মুখ্য আকর্ষণ, বিশেষত আমার মতো মানুষদের।
ইংরেজি ক্যালেন্ডারে ছবির বিষয় ও উপস্থাপনা এত বৈচিত্র্যপূর্ণ যে ভাবতে বসে থই পাওয়া যায় না। এমন সব তাক-লাগানো ক্যালেন্ডার দেখেছি এই জীবনে কী বলবো! ইতিহাস, ভুগোল, বিজ্ঞান, সঙ্গীত, সাহিত্য, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, নাটক, চলচ্চিত্র সবকিছুই ক্যালেন্ডারের বিষয়। ক্যালেন্ডারের পাতায় হাতে আঁকা ছবি ও আলোকচিত্র দুইয়েরই সমান ওজন ও চাহিদা। একসময় হাতে আঁকা ছবির দাপট একটু বেশিই ছিল। বিশেষ করে দেবদেবী, পুরাণনির্ভর বিষয়ের ক্যালেন্ডার হলেই শিল্পীর হাতের কেরামতি।
ওঃ, সে যে কী অলৌকিক সব চিত্রকল্প। দেখেছি সতীর দেহ কাঁধে নিয়ে শোকাহত শিবের তাণ্ডব নৃত্য, দেখেছি রামপ্রসাদকে বেড়া বাঁধায় সাহায্য করছেন মা কালী। অথবা লিপস্টিক রঞ্জিত ঠোঁটে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, শ্যাম্পু করা শৌখিন চুলে বিপ্লবী ক্ষুদিরাম। তবে আমার দেখা শ্রেষ্ঠতম চিত্রকল্পনা হলো, জিভ বের করে মা কালীর শাঁখ বাজানো। সে ছবিও ক্যালেন্ডারে প্রকাশিত। ছোটবেলায় অফিসফেরত বাবার আনা ক্যালেন্ডারে এইসব ছবি দেখতাম। তখন তো মুগ্ধতার কাল, যা দেখতাম তাই ভালো লাগত। ক্যালেন্ডারের ছবি দেখে নিজেও ছবি এঁকেছি ঢের। পুরোনো হয়ে যাওয়া ক্যালেন্ডারের পিছনের সাদা পাতা ছিল বড় ছবি আঁকার সর্বোত্তম স্থান। আমাদের শৈশবে চাইলেই আস্ত ড্রইংশিট মিলত না। এ ভাবে বাল্যকাল থেকেই ক্যালেন্ডারের সঙ্গে বেঁচে থাকা।
বয়স বাড়ার সঙ্গে দেখলাম, বাঙালি জীবন থেকে দেওয়ালের পরিসর ক্রমশ কমছে। ফ্ল্যাটবাড়ির আঁটোসাঁটো জীবনে ক্যালেন্ডারের স্থান নেই বললেই চলে। এখন প্রায় সবকিছুই স্মার্টফোনের শাসনে। সময়, তারিখ, ছুটির দিন, অ্যালার্ম ঘড়ি, ক্যালকুলেটর সমস্ত কিছুর চাহিদা মেটায় সেই আজব যন্ত্র। কিন্তু তাই বলে কি অসুখবিসুখ হওয়ার পরে জিলিপি-সন্দেশের মতো যাবতীয় অভ্যেসকে ছেড়ে দেওয়া যায়? ক্যালেন্ডার তেমনই এক পুরোনো অভ্যেস। সেই সুখের অভ্যেসেই আবিষ্ট আমি আজও ক্যালেন্ডার বানাই, নিজের জন্য তো বটেই সব্বার জন্যও।
কত সব সুন্দর দিনপঞ্জি নির্মাণের স্মৃতিতে ঘেরা এ জীবন। একবার ফোটোগ্রাফির প্রতিষ্ঠান ‘থার্ড আই’-এর জন্য করেছিলাম ‘ছুটির ক্যালেন্ডার।’ সেখানে ছবিতে ছিল ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে এক অলস বাঙালি বসে আছে, চোখ বন্ধ। আর তার নীচে বারোটি মাসে শুধু ছুটির দিনগুলো ছাপা, বাকি কর্মদিবস সব অদৃশ্য।
দিনপঞ্জিতে বিখ্যাত ব্যক্তিত্বকে স্মরণ করা বহুল প্রচলিত রীতি। সেই অনুষঙ্গে অজস্র ক্যালেন্ডার আমিও করেছি। নব্বইয়ের দশকে একটি ওষুধ কোম্পানির জন্য চিকিৎসা-বিজ্ঞানে নোবেলজয়ীদের পোর্ট্রেট এঁকে ক্যালেন্ডার করেছিলাম পরপর বেশ কয়েক বছর। কিংবা ‘আকাশ’ পত্রিকার জন্য বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত বারো জন সম্পাদকের প্রতিকৃতি দিয়ে তৈরি হয়েছিল একটি ব্যতিক্রমী ক্যালেন্ডার। ছবির সঙ্গে সেখানে সম্পাদকদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি লিখে দিয়েছিলেন প্রকাশ দাস বিশ্বাস।
আমাদের নিজস্ব চিত্রচর্চাকেন্দ্র ‘উদ্ভাস’-এর ক্যালেন্ডারের কথা এ বার বলি। ২০০৫ সাল থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে আসছে শিল্পী ও শিল্পকলা নিয়ে ‘উদ্ভাস’-এর দিনপঞ্জি। প্রথম বছরে বিষয় ছিল ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের চিঠি ও ছবি। পরবর্তীকালে কখনও রেমব্রান্ট অথবা কিউবিজম, কখনও রামকিঙ্কর বেইজ কিংবা বিষ্ণুপুরের দশাবতার তাস দিয়ে সেজে উঠেছে ক্যালেন্ডারগুচ্ছ। এমনকি নন্দীগ্রামে গণহত্যার প্রতিবাদেও তৈরি হয়েছে ক্যালেন্ডার। একটি আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দিনপঞ্জি নির্মাণের নিদর্শন বাস্তবিকই দুর্লভ। ২০১৮ সালে ‘উদ্ভাস’-এর ক্যালেন্ডারের বিষয় ছিল হাজার বছরের পুরোনো বাঙালির আঁকা ছবি। এই সব চার-পাঁচ পাতার ক্যালেন্ডারের মাধ্যমে আমরা চাই ছবির আনন্দ, আমাদের ঐশ্বর্য বন্ধুদের ঘরকে আলোকিত করুক। একটি বছরকে সাজিয়ে তোলার চেষ্টা নিশ্চয়ই ছুটির দিন দেখার চেয়ে কম আনন্দের কিছু নয়। এই আকর্ষণেই আমি ক্যালেন্ডার তৈরি করি। শীতকাল এলেই ছোটবেলার সেই আনন্দ আজও সিম্ফনির মতো বেজে ওঠে। নতুন একটি বছর মানেই নতুন দিনপঞ্জি, চিত্রকলার প্রশান্ত উৎসব।