অসিত পাল

নিউ ইয়ার নব নব হিড়িক আনে পলে পলে। আমাদের শিশুকালে যখন দু’একটা বাড়িতে সাদাকালো টিভি এল, তখনই গ্রিটিংস কার্ড মেগা হিট হয়ে কাঁপিয়ে দিল দাদাদের। দাদাদের হাতেই দেখেছিলাম সেই রংদার কার্ড। ভেবেছিলাম, বড় হলে আমিও কাউকে গ্রিটিংস কার্ড দেব। তবে পয়লা বৈশাখও সবুজ গ্রামের পরশ দিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু এখনকার হ্যাপি নিউ ইয়ারে ডিজে-র দাপটে কি দাঁড়াতে পারবে আমাদের নববর্ষ?

ঢাকার রমনার বটমুলের ছায়াতলে প্রতিবার বর্ষবরণ হয় এবং হবেও হয়তো। কিন্তু ভয়ও হয় এটা ভেবে যে, কতদিন এই ঐতিহ্য ধরে রাখা যাবে! উৎসব তো শুধুই উৎসব নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে ঐতিহ্যও। ঐতিহ্যের উপর আঘাত আসে বিভিন্ন কোণ থেকে। যতই প্রয়োজনীয়তা থাকুক, উৎসবের উপর নতুন রং লাগে, মানুষ ভুলে যেতে চায় পুরাতনকে। ঘষতে ঘষতে আসল রংটা উঠে যায়। বাংলা নববর্ষ নিয়ে ভাবতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, উৎসব পালন করতে গিয়ে ইতিহাসকে আমরা ক’জন মনে রাখি? ঐতিহ্য পরিবর্তন করতে করতে আমরা কি নিজেদের পরিচয়ও হারিয়ে ফেলছি? পয়লা বৈশাখ, ২৫ বৈশাখ বা ২২ শ্রাবণ ছাড়া আমরা আর ক’টা বাংলা তারিখ মনে রাখতে পারি? এই গোটাকয়েক বাংলা তারিখ মনে রাখার নেপথ্যে আবার ফেসবুকের অবদান অনস্বীকার্য। ঠারেঠোরে আমরাও এখন বুঝতে পারি, যত দিন যাচ্ছে ততই নিউ ইয়ারের কাছে হেরে যাচ্ছে নববর্ষ। কিন্তু নববর্ষেরও একটা ইতিহাস আছে, ঝলমলে অতীত আছে, আছে স্মৃতি মেদুরতা।

বাংলাদেশের ছায়ানটের বর্ষবরণ শুরু হয়েছিল ১৯৬০ সালে। পাকিস্তানি শাসক বাঙালির সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ঐতিহ্য ধ্বংস করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। ফতোয়া জারি করা হয়েছিল এই বলে যে, বর্ষবরণ হিন্দুরীতি। এটা মুসলিমরা পালন করতে পারবে না। পাকিস্তানি শাসক বাঙালি আর মুসলিমদের আলাদা সত্তা বলে ভাবতে শুরু করে। ভাবার কারণটা ছিল রাজনৈতিক। ঐতিহ্য ধ্বংস না করলে যে একটা জাতিকে ধ্বংস করা যায় না তা পাকিস্তানি শাসক জানত। এই ফতোয়ার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ছাত্র, শিক্ষক, সাধারণ মানুষ ঢাকার রমনার বটমুলের ছায়ানটে বর্ষবরণ উৎসব শুরু করে। ১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঢাকার এই বটমুলের ছায়াতলে বৈশাখী উৎসব করেছিলেন এবং সেটাও ছিল প্রতিবাদী উৎসব, বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। শোভাযাত্রা বের হয়েছিল সেদিন। ১৯৬০ সালেও শোভাযাত্রা বের হয়। কিন্তু পাকিস্তানি ফৌজ সেই শোভাযাত্রায় অত্যাচার চালায়। সেদিন উৎসব গোটা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে, পশ্চিমবঙ্গেও বর্ষবরণের রীতি মেনে পয়লা বৈশাখ পালিত হয়।

প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমানে ব্রাত্য তালিকায় পড়ে যাওয়া বাংলা নববর্ষ কি ১৯০৫ সালের আগে পালিত হত না? অবশ্যই হত এবং যে বাংলা নববর্ষকে পাকিস্তানি শাসক হিন্দুরীতি বলে বাতিল করতে চেয়েছিল সেই নববর্ষের প্রবর্তক নাকি ছিলেন সম্রাট আকবর। বির্তক আছে এই ঐতিহাসিক তত্ত্বেও। কারণ, অনেকে মনে করেন আকবরের আগে নববর্ষ বাংলায় প্রচলিত ছিল। আকবর ছিলেন পুরোদস্তুর আধুনিক এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। আকবর সম্রাট হওয়ার পরে লক্ষ করেন, উত্তরপূর্ব ভারতে গ্রেগরীয় পঞ্জিকা অনুসারে এপ্রিলের মাঝামাঝি বছরের শুরু ধরে প্রজারা বছর গণনা করে। প্রজারা বর্ষবরণ করত কৃষিকাজের নিয়ম মেনে। আর গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় বছর গণনা হত সূর্যমাস ধরে। কিন্তু মোঘল শাসকেরা খাজনা আদায় করত হিজরী মাস ধরে যা চান্দ্রমাস। কৃষকদের হিজরী সন ধরে খাজনা দেওয়া মুশকিল হত। কারণ, ভারতের কৃষি সূর্যসনের উপর নির্ভর করে।

সম্রাট আকবর সুষ্ঠু ভাবে খাজনা আদায় করতে বাংলা বছর গণনা শুরু করার প্রয়োজন বোধ করেন। তখনকার বিখ্যাত জ্যোর্তিবিজ্ঞানী ফতেহউল্লাহ সিরাজিকে এ ব্যাপারে দায়িত্ব দেন। সিরাজি সাহেব গ্রেগরী সন এবং হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বর্ষপঞ্জি তৈরি করেন। তাঁর তৈরি এই নব্য সনকে বলা হত ফসলি সন। কথিত আছে, বর্ষবরণের জন্য সম্রাট প্রজাদের নানা ভাবে উৎসাহ দিতেন। তবে বাংলা নববর্ষ নাকি শুরু হয় ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর থেকে। কারণ ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর আকবর সিংহাসনে বসেন। পল্লব সেনগুপ্ত কিন্তু শশাঙ্ককে বাংলা নববর্ষের প্রবর্তক মনে করেন। মিষ্টিমুখ করে নতুনকে বরণ এবং তেতো খেয়ে তিক্ততা দূর করার বিষয়টি শশাঙ্ক প্রবর্তন করেন বলে পল্লব সেনগুপ্ত মত দিয়েছেন।

তবে আকবরই যে উত্তরপূর্ব ভারতে বাংলা নববর্ষ শুরু করেন এটা হিন্দু মত স্বীকার করে না। হিন্দু মতে, নববর্ষ বিক্রমী দিনপঞ্জির সঙ্গে সম্পর্কিত। এটা নাকি চলে আসছে খ্রিস্টপূর্ব ৫৭ অব্দ থেকে। হিন্দু মতকে ফেলা যায় না। কারণ, বাংলা মাসের নামগুলি সূর্য সিদ্ধান্ত থেকে নেওয়া। আধুনিক বাংলা নববর্ষ শুরু হয়েছিল নাকি ১৯১৭ সালে। ব্রিটিশরা প্রথম মহাযুদ্ধে জয়ের পরে বাংলা নববর্ষ পালনের জন্য উৎসাহ দেয়। সেটা অবশ্য উৎসাহ না হয়ে আদেশও হতে পারে। খোল-করতাল বাজিয়ে কীর্তন গেয়ে নববর্ষ সেই বছর থেকে শুরু হয়। কিন্তু তার আগে কি বন্ধ ছিল বাংলা নববর্ষ?

ইতিহাস থাকতেও পারে না-ও পারে কিন্তু এই উৎসবে সামাজিকতা ছিল। মিষ্টিমুখ, নতুন বস্ত্র পরা, হালনাগাদ করার জন্য দোকানির  নতুন খাতা খোলা যাকে আমরা হালখাতা বলি, আলপনা দেওয়া, গ্রামে গ্রামে নামহট্টের বা নামযজ্ঞের মণ্ডপ তৈরি— এ সবই সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টির পরিচয় বহন করে। সেই সময় পশ্চিমবঙ্গে চৈত্র শেষের দিকে এগোতেই পয়লা বৈশাখের জন্য অপেক্ষা শুরু হত। কারণ, এই দিনে সূর্য মীনরাশি ত্যাগ করে মেষরাশিতে প্রবেশ করে। গ্রেগরী সন অনুসারে, পয়লা বৈশাখের আগের দিনটি পবিত্র চৈত্র সংক্রান্তি। এই দিনটিতে গ্রাম বাংলা সেজে উঠত গাজনের পরবের জন্য। মেষরাশিতে পৃথিবী প্রবেশ করার জন্য পয়লা বৈশাখে সবাই স্নান করে নতুন বস্ত্র পরত, মিষ্টি, অম্বল, তেতো ভক্ষণ করত। কারণ, তিক্ততা, অম্লতা দূর করার রীতি ছিল এটা। উৎসবের সঙ্গে ধর্ম জড়িয়ে না থাকলে সামাজিকতা আসে না!

এখন তা হলে আমাদের কোনটা হারিয়ে গেল, ধর্ম না সামাজিকতা ? যে বাংলা নববর্ষ আজ দুয়োরানি অর্থাৎ দুয়ো খাচ্ছে তার কিন্তু গ্রাম বাংলায় সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় গুরুত্ব ছিল। নিজস্ব রীতি অনুযায়ী নববর্ষ পালন করা হতো বাংলার সব প্রান্তে। নদিয়ার করিমপুরের মাহিষ্য সমাজে রং করা কলসি জলভর্তি করে অন্য আত্মীয়ের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার রীতি ছিল। বাংলাদেশে বৈশাখী মেলার আয়োজন হতো। রাঢ় অঞ্চলে ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তা খাওয়ার রীতি ছিল। বাংলাদেশে গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হত। বরিশালের ময়দানে জব্বারে বলি নামে যে খেলা হতো সেটা আসলে কুস্তি। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করেছিল পয়লা বৈশাখে। এই শোভাযাত্রায় বাংলার কুটির শিল্পের প্রদর্শনী থাকত। মৌলবাদীদের শাসানি উপেক্ষা করে এখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মঙ্গলশোভা যাত্রা বের করে।

নদিয়ার কুম্ভকার সম্প্রদায় পয়লা বৈশাখ অন্যভাবে পালন করত। এখন আর করে না। তাছাড়া মাটির তৈজসপত্রও সে ভাবে তৈরি হয় না। প্লাস্টিকের যুগে মাটির জিনিসপত্র আর কে কিনবে? কুমোরের চাককে বৈশাখে বিরাম দেওয়ার রীতি ছিল। কুমোরদের বৈশাখে মাটি কাটতে হয় না। বৈশাখ তাদের কাছে খুব পবিত্র মাস। গোটা মাস তারা মাটির কাজ করে না। পয়লা বৈশাখে পুনমহড় পরিষ্কার করে, চাক ধুয়ে, পুরোহিত ডেকে পুজো দিয়ে কুমোররা কাজের বিরাম শুরু করত। বৈশাখ শেষ হলে আবার পুজো দিয়ে কাজ শুরু হত। এ তো বেশিদিন আগের কথা নয়। তখনও হ্যাপি নিউ ইয়ার জীবনের ওপর চড়া রঙের প্রলেপ দেয়নি। শহুরে জীবনে গুরুত্ব পেলেও গ্রামের এবড়ো খেবড়ো চালচিত্রে বাংলা তারিখের তখনও গুরুত্ব ছিল। আমাদের পূর্বপুরুষেরা ইংরেজি তারিখ মনে রাখতে পারত না। গোটা গ্রামে দু’-একটা পাঁজি থাকত। বিয়ে, অন্নপ্রাশন, শ্রাদ্ধ, ষষ্ঠীপুজো, শীতলা— সব কিছু ওই পাঁজি দেখেই হত। আদি সেই পাঁজি গবেষণার গোয়াল ঘরে চলে গিয়েছে। জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে, শ্রাদ্ধ— সবই এখন ইংরেজি তারিখে চলে। শপিং মলে হালনাগাদ হয় না। ক্যালেন্ডারও দেয় না। গাঁ-গঞ্জে এখনও হালখাতা হয় বটে তবে তারও বেলা পড়ে এল বলে। আমরা, মানে গ্রামের ক্রেতারা ক্যালেন্ডার পাই এখনও, তবে সে সব ক্যালেন্ডারে বাংলা তারিখকে তৃতীয়ার চাঁদের মতো রাখা হয়।

পয়লা বৈশাখ এখন পরব, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির চেয়েও দেখানোপনার উৎসব হয়ে যাচ্ছে। ওই দিন ধুতি-পাঞ্জাবি পরে বাঙালি সেজে আমরা ছবি পোস্টিয়ে ফেসবুকে কমেন্টস গুনি। অন্যদিকে, হ্যাপি নিউ ইয়ার আধুনিক, মডার্ন, মাদকতাময়। কারণ নিউ ইয়ারে পিকনিক আছে, দেদার মদ্যপান আছে, বেপরোয়া বাইক ছোটানো আছে, মৃত্যু আছে, পার্টির হুল্লোড়ে হত্যা আছে, একলা ফেরা তরুণীর নিরুদ্দেশ আছে, ধর্ষণ আছে। এমন সব ঘটনার ঘনঘটার কাছে বাংলা নববর্ষের রং বড্ড ফিকে, ম্যাড়মেড়ে। তাই, ফুল ফুটুক নাই বা ফুটুক, ভুল ভাঙুক নাই বা ভাঙুক, লেটস সেলিব্রেট… হ্যাপি নিউ ইয়ার!

(লেখক বালিয়াডাঙা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত)

(ফিচার ছবি গুগল থেকে নেওয়া)