মহম্মদ জাহাঙ্গীর আলম
দীর্ঘ ৩৩৩ দিন পরে শুক্রবার স্কুল খুলল। আমার শিক্ষকতা ও ছাত্রজীবনে এই প্রথম এতদিন বিদ্যালয় বন্ধ ছিল। প্রথম দিনেই বিদ্যালয়ে যে এত ছেলেমেয়ে উপস্থিত হবে, ভাবতেই পারিনি! এক্কেবারে আট পিরিয়ড! কী যে ভাল লাগছে!
আজকের দিনে স্কুল খোলা নিয়ে যেমন ছেলেমেয়েদের মধ্যে ছিল তীব্র আগ্রহ, তেমনই আমাদের মধ্যেও ছিল দারুণ ভাললাগা। এগারো মাস নীরবে, নির্জনে থাকা বিদ্যালয় প্রচুর ছেলেমেয়ের উপস্থিতিতে যেন প্রাণ ফিরে পেল। মাসের পর মাস বিদ্যালয়ের খোলামেলা, ঝলমলে পরিবেশ থেকে পড়ুয়ারা ছিল বহুদূরে। অনেকের বিদ্যালয় জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছিল। যেমন দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়াদের বিদ্যালয় ছেড়ে যাওয়ার সময় এসে যাচ্ছিল। কিন্তু একসঙ্গে মহানন্দে ক্লাস করার মজা, ভাললাগা সব কিছু করোনা চুরি করে পালাচ্ছিল। তাই বিদ্যালয়ে ক্লাস করা নিয়ে ছেলেমেয়েদের মধ্যে ছিল তীব্র আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু হঠাৎ করে স্কুল খোলার দিনই (১২ ফেব্রুয়ারি) রাজ্যজুড়ে বনধের ঘোষণা ওদের মনখারাপ করে দিয়েছিল। ওরা বার বার ফোন করতে থাকে। আমাদের বিদ্যালয় পরিবার ও অন্য ক্লাসের গ্রুপে ওদের আশ্বস্ত করে বলি যে, লস্করপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে পিকেটিং হয় না। তোমাদের ভয় নেই। ধর্মঘটের পিকেটিং না হলে তোমাদের ক্লাস হবে।
যাইহোক, শুক্রবার সকালে বিদ্যালয়ের সামনে গিয়ে যখন দেখি, ছেলেমেয়েরা কোভিড প্রোটোকল মেনে মাস্ক পরে বিদ্যালয়ে ঢুকছে, কেউ স্কুল বন্ধ করতে পতাকা নিয়ে হাজির হননি, তখন এলাকার মানুষকে মনে মনে ধন্যবাদ দিই। মুখে মাস্ক লাগিয়ে ছেলেমেয়েদের উজ্জ্বল খুশি উপচে পড়া ইউনিফর্ম পরা চেহারা দেখে খুব ভাল লাগছিল। নবম শ্রেণিতে ক্লাস করতে গিয়েছি। ওরা বলল, ‘‘স্যর খুব ভাল লাগছে স্কুলে আসতে পেরে। বাড়িতে ভাল লাগছিল না। পড়াও হচ্ছিল না।’’ ক্লাস থেকে ফেরার সময় দেখি, দশম শ্রেণির এক ছাত্রীর মুখে মাস্ক নেই। বললাম, মাস্ক পর। সে বলে, ‘‘স্যর, মাস্ক পরতে ভাল লাগে না। তাছাড়া করোনা তো আর নেই!’’ ওকে বোঝানো হল, মাস্ক পরা, হাত সানিটাইজ় করার উপকারিতা। অবশেষে সে বুঝল। তবে দশম ও দ্বাদশ শ্রেণির ছেলেমেয়েরা সবচেয়ে খুশি ওদের ক্লাস ও প্রাকটিক্যাল শুরু হওয়ায়। বোনাস হিসেবে বহুদিন পরে একসঙ্গে দেখা হওয়া ও আড্ডা।
আজ সমবেতভাবে প্রার্থনাসঙ্গীত হয়নি। ক্লাসের শুরুতেই কেন্দ্রীয় ভাবে প্রত্যেক শ্রেণিকক্ষে থাকা সাউন্ড সিস্টেমের মাধ্যমে কীভাবে কোভিড প্রোটোকল মেনে চলতে হবে, তা নিয়ে এক শিক্ষিকা বক্তব্য রাখলেন। স্কুল শুরুর প্রথম দিনে ধর্মঘট সত্ত্বেও সকল শিক্ষক-শিক্ষিকা বিদ্যালয়ে হাজির হয়েছিলেন। ক্লাস নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যেও দেখলাম প্রবল আগ্রহ। বহুদিন পর চক-ডাস্টার হাতে শিক্ষক শিক্ষিকাদের এ ক্লাস, সে-ক্লাসে ছোটাছুটি ভাল লাগছিল। অন্যদিকে, আজ ছিল উজ্জ্বল মনোরম আবহাওয়া। না গরম, না শীত। ক্লাস করার জন্য আদর্শ পরিবেশ। ১১ মাস পরে বিদ্যালয়ের প্রথম দিনেই আট পিরিয়ড ক্লাসের পরে পড়ুয়া-শিক্ষক সকলের মুখেই ছিল হাসির বহিঃপ্রকাশ। তবে মাস্কের সৌজন্যে ওদের হাসিমুখ দেখতে পাচ্ছিলাম না!
লেখক লস্করপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক
(ফিচার ছবি গুগল থেকে নেওয়া)