তানিয়া বন্দ্যোপাধ্যায় পাল

দীর্ঘ দশ মাস পরে ফের রাজ‍্যে স্কুল খুলল। অতিমারি আবহে স্কুল আর পড়ুয়ার এই বিচ্ছেদ কমবেশি বিশ্বের সব দেশ প্রত‍্যক্ষ করেছে। আমাদের রাজ‍্যও তার ব‍্যতিক্রম নয়। কিন্তু এই অতিমারি থেকে আমরা কিছু শিখলাম কি? উত্তরটা সহজ ভাবে দিলে হয়তো দাঁড়াবে— না!

অতিমারির বিপর্যয় সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন তুলেছে আমাদের দায়বদ্ধতা নিয়ে! নাগরিকদের দায়িত্ব, সরকারের দায়িত্ব, নীতি প্রণয়নে দূরদর্শিতা, একটা অতিমারি আমাদের শুধু জরা আর মৃত‍্যু দেখায়নি। আধুনিক সমাজের নানা দিক নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। কিন্তু স্কুল খোলার পরের সরকারি সিদ্ধান্ত আবার সেই দায়বদ্ধতার শিক্ষা নিয়েই জিজ্ঞাসা চিহ্নকে জোরালো করলো।

সরকারের তরফে জানানো হয়েছে, স্কুল খোলার পরে কোনও পড়ুয়ার করোনা হলে তার দায়িত্ব সরকারের নয়। মা-বাবার অনুমতি চিঠি নিয়ে পড়ুয়া স্কুলে আসবে। যদি কোনও অভিভাবক অনুমতি চিঠি দিতে রাজি না হন, তাহলে সেই পড়ুয়া আর ক্লাস করতে পারবে না। অর্থাৎ, বিষয়টি যা দাঁড়ালো, বাবা-মা চিঠি লিখে জানাবেন, তাঁর সন্তানের স্বাস্থ‍্যের সুরক্ষার কোনও দায়িত্ব স্কুল বা সরকারের নয়। এই মুচলেকানা দিলে তাঁর সন্তানের শিক্ষার অধিকার থাকছে না। কারণ, স্কুল খোলার পরে অনলাইন ক্লাসগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে, সরকারের নির্দেশ না মানলে পড়াশোনাও বন্ধ!

কিন্তু স্কুল বা তদুপরি সরকার কি সত‍্যিই দায়িত্ব এড়াতে পারে? নাকি নাগরিক হিসাবে সরকারের থেকে আমাদের প্রত‍্যাশা বেশি? এ দেশের বহু স্কুলে এখনো শৌচালয় না থাকা একটি বড় সমস‍্যা। বছর খানেক আগে এক সরকারি রিপোর্টে জানানো হয়েছিল, স্কুলে শৌচালয় না থাকায় এ দেশের ৩৯ শতাংশ ছাত্রী স্কুলে যেতে চায় না। সেখানে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে স্বাস্থ‍্যবিধির পরিকাঠামো তৈরির আশা করা হয়তো অলীক কল্পনা। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, সরকার যদি সেই কাজে এগিয়ে না আসে, তাহলে কে করবে? করোনা মোকাবিলা তো কোনও একক ব‍্যক্তির দ্বারা সম্ভব নয়। স্বাস্থ‍্যবিধি মেনে চলার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো তৈরির দায়িত্ব কে নেবে?

এ দেশে পরিস্রুত জল তো দূর অস্ত কল খুলে জল পাওয়ার পরিষেবাটুকুও নেই অনেক স্কুলে। তাই পড়ার বইয়ে হাত ধুয়ে খাওয়ার ছবি থাকলেও, পর্যাপ্ত জলের ব‍্যবস্থা না থাকায় সেই সব স্কুলে মিডডে মিল খাওয়ার আগে পড়ুয়ারা হাত ধুতেই পারে না। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, সেই রাজ‍্যের স্কুলগুলোতে স‍্যানিটাইজ়ারের ব‍্যবস্থা করা যাবে কি? করোনা ঠেকাতে হলে বারবার হাত ধুতে হবে। জল কোথায় পাবে? নাকি বাড়ি থেকে পড়ুয়ারা জলের আলাদা ব‍্যবস্থা করে আনবে? কিন্তু এ রাজ‍্য তো শুধু কয়েকটা শহরকে নিয়ে নয়। এ রাজ‍্যের একাধিক জেলায় এখনো পরিস্রুত জল পাওয়া অন‍্যতম বড় সমস‍্যা। সেখানের পড়ুয়ারা তাহলে কী করবে?

এ রাজ‍্যের বহু ছাত্র-ছাত্রীর আর্থিক দিকের কথা মাথায় রেখে প্রশ্ন ওঠে, তাদের মাস্কের ব‍্যবস্থা কীভাবে হবে? কারণ, যে রাজ‍্যে স্কুলছুট কমাতে সরকারকে খাবার-ব‍্যাগ-জুতো দিতে হয়, সেই সরকারের কি এই অতিমারি আবহে আর একটু স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে সতর্ক হওয়া দরকার ছিল না?

২০২০ সালেই ইউনিসেফ প্রশ্ন তুলেছিল, স্কুল খোলার পরে শিশু স্বাস্থ‍্যের নিরাপত্তা কী ভাবে বজায় থাকবে? অতিমারি আবহেই তারা জানিয়েছিল, এই দায়িত্ব সরকার না নিলে বিপদ আরও বাড়বে। পাশাপাশি এ দেশের বেশিরভাগ স্কুলে যে স্বাস্থ‍্যবিধি বজায় রাখার ন্যূনতম পরিকাঠামো নেই সে কথাও ইউনিসেফ এক বিবৃতিতে জানিয়েছিল। তবে, রাজ‍্য সরকারের এই সিদ্ধান্ত শুধু পরিকাঠামোগত পিছিয়ে থাকাই নয়, সদিচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন তুলছে। করোনা অতিমারির বিপদ এখনও শেষ হয়নি। সে কথা ভুলে গেলে বিপদ আবার হানা দিতে পারে।

(ফিচার ছবি গুগল থেকে নেওয়া)