মৌসুমী মজুমদার

‘বঙ্গভাষা’ কবিতায় মাইকেল মধুসূদন দত্ত বঙ্গ ভাণ্ডারের বিবিধ রত্নের প্রতি গভীর শ্রদ্ধায় প্রণত হয়েছেন, বঙ্গভাষার আশ্রয়ে ফিরে শান্তি পেয়েছেন। মাইকেলের সেই গর্বের ভাষা, রবীন্দ্রনাথের কাব্যসাধনার ভাষা, ফকির লালনের মরমের ভাষা বর্তমানে গভীর অসুখে ভুগছে। আমাদের মায়ের ভাষা আজ অপ শব্দ, ইতর শব্দ, বদ শব্দের দাপটে মলিন ও হতশ্রী। ইংরেজি ও হিন্দি শব্দের বহুল প্রয়োগ, বাংলা ভাষার বিকৃত উচ্চারণ বাংলা ভাষার প্রাণবায়ু কেড়ে নিচ্ছে। একদা যে ভাষার জন্য হাজার হাজার মানুষ রচনা করেছিল এক রক্তাক্ত ইতিহাস, আজ সেই ভাষা বহু জনের মুখে লাঞ্ছিত, বিকৃত ও ধর্ষিত হয়ে চলেছে।
রাজনীতির অঙ্গনে চলেছে কু-কথার তোড়। কে কত বেশি খারাপ শব্দ ব্যবহার করতে পারে তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক বক্তৃতার নামে চলছে পরস্পরের বিরুদ্ধে নোংরা ভাষায় কাদা ছোড়াছুড়ি। নেতা-বিধায়ক-সাংসদ-মন্ত্রীদের একাংশ বেপরোয়া ভাবে ইতর শব্দ প্রয়োগ করে চলেছেন। চলছে লাগাতার নজিরবিহীন ব্যক্তিগত আক্রমণও। টিভি খুললেই রাজনৈতিক তরজার নামে আমজনতা শুনছে কোন্দল। রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাবেই মুখ থেকে নির্গত হচ্ছে কু-কথার ফোয়ারা। সারা সন্ধ্যা জুড়ে টিভি চ্যানেলগুলোতে এইসব তরজা টিআরপি যেমন বাড়াচ্ছে, তেমনই বঙ্গের মানুষকে ‘অলীক কুনাট্য রঙ্গে’ মজিয়ে রাখছে। কোনও কোনও নেতার বাংলা উচ্চারণ কানে যথেষ্ট বিঁধছে।
এর মধ্যেই আবার বাংলা ভাষাকে ঢাল করে চলেছে দু’পক্ষের লড়াই। শাসকদল প্রতিপক্ষকে ‘বহিরাগত’ তকমা দিয়ে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার স্বঘোষিত দায় গ্রহণ করেছে, অন্যদিকে বিরোধী দলও যে পিছিয়ে নেই তা প্রমাণ করতে বিকৃত উচ্চারণে রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, সুভাষচন্দ্রকে উদ্ধৃত করে চলেছে।  এই দড়ি টানাটানিতে নাভিশ্বাস উঠেছে বাংলা ভাষারই। উভয়ের টক্করে আসলে বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি আরও নিচুস্তরে চলে যাচ্ছে। বাংলা ভাষার সম্মানহানি এখন এই বাংলার রোজনামচা। যে কোনও দূষণের মতোই ভাষা-দূষণও মাত্রা ছাড়িয়েছে।
বাংলা-ইংরেজি-হিন্দি মেশানো খিচুড়ি ভাষায় কথা বলতে আজকের প্রজন্ম অভ্যস্ত। ভিন্ন ভাষার সুরে বাংলা ভাষায় কথা বলা এখন ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘জন-গণ-মন-অধিনায়ক জয় হে’ জাতীয় সঙ্গীতকে ‘জানা-গানা-মানা-অধিনায়ক জায়া হে’ উচ্চারণে গাইতেই অনেকে গর্ব বোধ করছে। বাক্যের মাঝে সঠিক বাংলা শব্দ মনে না পড়ায় হিন্দি শব্দ ব্যবহার করে কাজ চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ‘গদ্দার’, ‘জোশ’, ‘গোলি মারো’ ইত্যাদি শব্দ অবলীলায় বাংলা বাক্যে স্থান করে নিচ্ছে। অবশ্য এটা ঠিক যে, বাংলা ভাষায় শব্দ ভাণ্ডারে প্রচুর আরবি-ফারসি, ওলন্দাজ, বর্মী, চিনা, ইংরেজি ইত্যাদি নানা বিদেশি শব্দ আছে। কিন্তু সেগুলি ধীরে ধীরে যে ভাবে বাংলা ভাষার মধ্যে আত্মগত হয়ে গিয়েছে, নতুন ব্যবহৃত হিন্দি বা ইংরেজি শব্দগুলো হয়নি। ফলে এ সব শব্দ কান ও মনের পক্ষে যথেষ্টই পীড়াদায়ক।
বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা কথার মধ্যে অবলীলায় বহু ‘স্ল্যাং’ ব্যবহার করছে। সমাজের এক শ্রেণির লোকজনের অনেকই কথ্যভাষায় দেহজ বহু শব্দকে স্ল্যাং হিসেবে ব্যবহার করে। যৌন বিষয় বা যৌনাঙ্গ হামেশাই তাদের কথায় উচ্চারিত হয়। দারিদ্র্য, বিরক্তি তাদের বাধ্য করে এ জাতীয় ভাষা ব্যবহারে, যৌনবিকার সৃষ্টি তাদের উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু সমাজের তথাকথিত উচ্চ বা মধ্যবিত্ত শ্রেণির ছেলেমেয়েদের সে দায় নেই। তারা আমোদের উপকরণ হিসেবেই এ জাতীয় অপশব্দ ব্যবহার করে। আজকাল নেট দুনিয়ার বেশিরভাগ সিরিজগুলিতেও ইতর শব্দের ছড়াছড়ি। কোনও ‘সেন্সর বোর্ড’ নেই এই শব্দগুলিকে ‘সেন্সর’ করার জন্য। যত বেশি আমরা এ সবের প্রতি উদাসীন থাকব তত বেশি এই অপ শব্দগুলি সমাজে ছড়িয়ে পড়বে।
দেখতে দেখতে আবার একটা একুশে ফেব্রুয়ারি চলে এল। কালের নিয়মে ভাষা দিবস আসবে, যাবে। কিন্তু শুধুমাত্র এই একটি দিনেই ‘মোদের গরব, মোদের আশা আ-মরি বাংলা ভাষা’ গান বাজিয়ে দায়িত্ব পালন করলে চলবে না। কু’কথার এই প্রবাহকে থামাতে হবে। নেতা-নেত্রীদের বক্তৃতায় অপশব্দের প্রয়োগ ঘটলে সেই বক্তব্য মিডিয়ায় বারবার প্রচার করা চলবে না। পথ চলতে বা আশেপাশে কারও মুখে কু-শব্দ শুনলে তার প্রতিবাদ করতে হবে। সমবেত ভাবে আমজনতাকেই ভাষার সম্মান রক্ষায় তৎপর হতে  হবে। যৌথ ভাবে সমাজের সর্বস্তর থেকে প্রতিবাদ হলে খানিকটা হলেও সুফল মিলবে। ভাষার পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। সেই পরিবর্তন হোক, নানা নব্য শব্দের আগমন ঘটুক। কিন্তু বাংলা ভাষার মালিন্যমুক্ত রূপটি বজায় থাক। বাংলা ভাষার প্রমিত রূপটির পাশাপাশি তার আঞ্চলিক রূপটিও বজায় থাক নানা বৈচিত্র্য নিয়ে। বাংলা শব্দের নানা প্রয়োগ-বৈচিত্র্য আমাদের বারবার মুগ্ধ করতে থাকুক। বিশ্বায়নের যুগে বাংলা ভাষার এই বিকৃতি বন্ধ করাই হোক ভাষা দিবসে বাঙালির অঙ্গীকার।

(ফিচার ছবি গুগল থেকে নেওয়া)