অনসূয়া বাগচী

ভাষা মানুষের অধিকার, মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম। ১৯৫২ সালে পূর্ব বাংলায় (পাকিস্তানে) ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ২১ ফ্রেব্রুয়ারি দিনটিকে আমরা প্রত্যেকবার স্মরণ করি। এই দিনেই ভাষার জন্য শহিদ হয়েছিলেন রফিক, সালাম, বরকত-সহ আরও অনেকে। ইউনিসেফ দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বর্তমান বাংলাদেশে এই শহিদ দিবস উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে উদযাপন করা হয়। সারা দেশ এক অভিন্ন অনুভূতিতে, গর্বের সঙ্গে দিনটি পালন করে।
বাংলাভাষা নিয়ে আন্দোলনের প্রসঙ্গে ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি আমাদের কাছে গুরুত্ব পায়। কিন্তু ১৯১২ সালে বাংলা ভাষা নিয়ে মানভূমে প্রথম আন্দোলন দেখা দিয়েছিল। ব্রিটিশ রাজত্বে মানভূমকে বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে বিহার-উড়িষ্যার সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। মানভূমের বাঙালিদের উপর হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেওয়া হয়। এই অঞ্চলে ভাষা আন্দোলন বহু দিন পর্যন্ত চলেছিল। বাংলা ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে অসমের বরাক উপত্যকার ১৯৬১ সালের আন্দোলন ছিল উল্লেখযোগ্য। বরাক উপত্যকায় বহু বাংলাভাষী মানুষের বাস ছিল। তাদের উপর অসমীয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়া হয়। তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে ১১ জন ভাষার জন্য প্রাণ দেন । তাই ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার জন্য শহিদদের কথা স্মরণ করলে, মানভূম ও অসমের বরাক উপত্যকার মানুষের কথাও অন্তত একবার স্মরণ করা প্রয়োজন।
আর এর সঙ্গে মনে রাখা দরকার, যে ভাষার জন্য আন্দোলনের কারণে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পেয়েছে, আমরা যেন সেই ভাষার প্রতি অবহেলা না করি। বাংলা ভাষার সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক অবিচ্ছিন্ন, তা দেশভাগ, জাতি বা সম্প্রদায়ের বৈষম্য দিয়ে বিভক্ত করা যায় না। বাংলায় কথা বলা লজ্জার নয়; ইংরেজি বা হিন্দিতে কথা বলতে না চাওয়াও অপরাধ নয়; অন্তত বাংলায় বাস করা মানুষের বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকার স্বীকৃতি পাক। ইংরেজি ভাষায় কথা বলার অন্য শর্ত হিসাবে বাংলা ভাষা ভুলে যাওয়া খুব গর্বের নয়।
এমনকি বাংলা-মাধ্যমে পড়াশোনা করা ছেলেমেয়েরা অনেকে বাংলা লিখতে, পড়তে ভুলে গিয়েছেন বলতে দ্বিধা বোধ করেন না, কারণ তাঁদের কাছে বাংলাভাষা গুরুত্বহীন ভাষা। সামর্থ্য না থাকলেও অনেকেই বহু টাকা খরচ করে ছেলেমেয়েদের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ান, পরিবারে ইংরেজির চর্চা না থাকায় বাচ্চা কী পড়ছে তা বোঝার জন্য আবার ছোটো থেকেই ‘প্রাইভেট টিউশন’-এর উপর নির্ভরশীল হতে হয়। আর এই প্রবাহে বাংলা-মাধ্যম স্কুলগুলোতে পড়তে আসা ছাত্র-ছাত্রী, এমনকি শিক্ষকদের মধ্যেও ‘এই পড়াশোনায় কী হবে’ মনোভাব বেড়েই চলছে, যার ফল খুব মারাত্মক হচ্ছে।
বাংলা-মাধ্যম স্কুলে পড়েও বহু মানুষ প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। বাংলা-মাধ্যম স্কুলে ইংরেজি ভাষা শেখার সুযোগ থাকে। তাই বাংলা-মাধ্যম স্কুলে পড়ানোর প্রতি বিশেষ করে শহরাঞ্চলে মধ্যবিত্তের অনীহা, আত্মবিশ্বাসের অভাব, স্কুলগুলির মান কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। হয়ত এখনই সচেতন না হলে ছাত্র-ছাত্রীর অভাবে আগামী দশ বছরে বাংলা-মাধ্যম স্কুলের সংখ্যাও অনেক কমে যাবে। বাঙালি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে, যে দেশে আছে সেই দেশের ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষার চর্চা করাও খুব প্রয়োজন। বাংলা ভাষার গুরুত্ব বৃদ্ধি না করতে পারলে বা বাংলা ভাষাকে সম্মান না দিতে পারলে ‘মাতৃভাষা দিবস’-এর গুরুত্ব থাকে না।

(ফিচার ছবি গুগল থেকে নেওয়া)