সুদীপ জোয়ারদার

‘বাজে কথার ঝুলি/যতই কেন ভর্তি কর/ধুলিতে হবে ধুলি’। কিছু কথা চেয়ে পাঠানো এক ভক্তের অটোগ্রাফ খাতায় রবীন্দ্রনাথ সেদিন খানিকটা রাগত হয়েই লিখেছিলেন লাইন ক’টি। তার আগে পার্শ্ববর্তিনীকেও জানিয়েছিলেন উষ্মা, ‘কি হবে রে কথা দিয়ে? কেবল কথা, কথা, কথা।’
করোনা আতঙ্কে কাঁপছে আমাদের দেশ-সহ তামাম দুনিয়া। এরই মাঝে রবীন্দ্রনাথ দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের বুকের বল-ভরসা হয়ে। কখনও ‘বিপদে মোরে রক্ষা কর’, কখনও ‘দুবেলা মরার আগে মরব না’ উচ্চারণে। অটোগ্রাফের কবিতাটিও কিছুটা যেন স্পর্শ করে গেল এই ক্রান্তিকালে পালনীয় ধর্মটিকে। কথা নয়, নয় অযথা কলরব, চাই শুধু কাজ। অটোগ্রাফের খাতায় কবিতা অবশ্য এটাই একমাত্র নয়। ‘ডেস্কেতে দেখিলাম, মাতা/রেখেছেন অটোগ্রাফ-খাতা।’ রবীন্দ্রনাথ নিজেই লিখেছেন এমন লাইন (‘অটোগ্রাফ’/রবীন্দ্রনাথ)। রানী চন্দের লেখা থেকে জানা যায়, ভক্তের আবেদনে সাড়া দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে কখনও শুধু অটোগ্রাফ, কখনও বা দু’-এক ছত্র কবিতা-সহ স্বাক্ষর রোজই দিতে হত প্রচুর। নিজস্বীর যুগে অটোগ্রাফের মাহাত্ম্য বোঝা কঠিন। যদিও এ যুগেও অটোগ্রাফ প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি পুরোপুরি। এখনও বইমেলায় বিখ্যাত লেখকদের নিজের বইয়ে দেদার অটোগ্রাফ বিলোতে দেখা যায়। কিন্তু আলাদা করে অটোগ্রাফ খাতা রাখার চল অনেক পুরনো, ভাল অভ্যেসের মতোই এখন অনেকটাই আমাদের স্মৃতির পাতায়। বিখ্যাত মানুষের অটোগ্রাফ মানে তাঁর শরীরী উপস্থিতির মতো একটা ব্যাপার। সে কাজটা মোবাইল যদি নিজস্বীর মাধ্যমে করে দেয় তো কে আর অটোগ্রাফের ঝামেলায় যায়! কিন্তু অটোগ্রাফ তো অনেক ক্ষেত্রে কেবল বিখ্যাত মানুষটির স্বাক্ষরেই মিটে যায় না। ভক্তদের জন্য দু’একটি অমূল্য কথা বিখ্যাত মানুষটি কখনও স্বেচ্ছায়, কখনও অনুরোধে লিখেও দেন। সে সব কথা কখনও ভক্তের জীবনে রয়ে যায় মহার্ঘ্য সঞ্চয় হয়ে। আবার বিখ্যাত মানুষটি রবীন্দ্রনাথ হলে সে সব কথা ভিন্ন ভাবে প্রাসঙ্গিকও হয়ে যায় কখনও। ‘ছেলেবেলায় আমারও একটি অটোগ্রাফ খাতা ছিলো এবং রবীন্দ্রনাথ যে বার ঢাকা গিয়েছিলেন, আরো অনেকের সঙ্গে তাঁর প্রসাদ-কণিকা আমিও পেয়েছিলাম। লজ্জার সঙ্গে স্বীকার করি যে খাতাটি আমি বহুদিন হলো হারিয়ে ফেলেছি, কিন্তু কবিতাটি আমার মনে আছে।…বাজে নিশীথের নীরব ছন্দে/বিশ্বকবির দান/আঁধার বাঁশির রন্ধ্রে রন্ধ্রে/তারার বহ্নি গান।’ লিখেছেন বুদ্ধদেব বসু।
গৃহবন্দি জীবনে ব্যালকনি বা বারান্দা আর রাতে ছাদ বা উঠোন এই তো এখন আমাদের স্বাধীন বিচরণক্ষেত্র। ব্যালকনি বা বারান্দায় কাজ ছাড়া একটু আধটু দাঁড়ানো হলেও ছাদ বা উঠোনে এই বন্দিত্ব না এলে আমরা কে আর কবে রাত্রিতে দাঁড়িয়েছি! আর শুধু দাঁড়ানোই তো নয়, করোনার করাল ছবি থেকে মুখ ফেরাতে এখন রীতিমতো চলছে প্রকৃতিকে আঁকড়ে ধরাও। তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে ‘আঁধার বাঁশির রন্ধ্রে রন্ধ্রে’ ‘তারার বহ্নিগান’ও কি আমাদের ছুঁয়ে যাচ্ছে না এ সময়! ‘যখন ছোট ছিলাম’ বইয়ে রয়েছে সত্যজিৎ রায়ের রবীন্দ্রনাথের অটোগ্রাফ-সহ কবিতা সংগ্রহের কাহিনি। সত্যজিৎ রায়ের তখন বছর দশেক বয়স। মায়ের সঙ্গে গিয়েছেন শান্তিনিকেতনে। পৌষমেলায় বালক সত্যজিৎ কিনলেন একটা অটোগ্রাফ খাতা। ভীষণ শখ প্রথম পাতাতেই রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে একটা কবিতা লিখিয়ে নেওয়ার। এক সকালে মায়ের সঙ্গে গেলেন উত্তরায়ণে। খাতাটা রবীন্দ্রনাথকে দিতে তিনি বললেন পরের দিন সকালে খাতাটা নিয়ে যেতে। পরের দিন মায়ের সঙ্গে খাতা আনতে গিয়ে পেলেন কাঙ্ক্ষিত জিনিস। রবীন্দ্রনাথ লিখে দিয়েছেন আট লাইনের একটি কবিতা। সে কবিতা আজ প্রায় সবার জানা। ‘বহুদিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে/বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে/দেখতে গিয়েছি পর্ব্বতমালা/দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু…।’ কবিতার নীচে রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষর। তারিখ ৭ই পৌষ, ১৩৩৬। আট লাইনের কবিতাটি কিন্তু আসলে শিকড়ে ফেরার কবিতা। ঘরের দিকে তাকানোর আহ্বান। ধানের শিষের ডগার শিশিরবিন্দুটি নিশ্চয়ই তাজমহল নয়, কিন্তু উপভোগের বিচারে সেও তুচ্ছ নয়। তাকে নিয়েও মেতে ওঠা যায়, মেতে থাকা যায়!

যাঁরা বিদেশ থেকে ফিরে এলেন এই সময়ে, কিম্বা যাঁরা বিদেশ থেকে ফিরে আসতে চেয়ে পারলেন না যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, তাঁরা কেউওই এমনি পড়ে থাকেন না বিদেশে। কিন্তু এই মহামারির প্রভাবে তাঁদের না হোক, আগামী প্রজন্মের দৃষ্টিটা একটু রাজ্যমুখী বা দেশমুখী, সার্বিকভাবে না হলেও কিছুটা কি হতে পারে না! মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়, খাটো কাজ মাথায় তুলে নিয়ে তাঁরাও কি লেগে যেতে পারেন না নতুনভাবে দেশগঠনে! বিপদের দিনে বিপদের কথা বেশি ভাবলে বিপদ কমে না। বরং বিপদ উত্তীর্ণ সময়ের একটা উজ্জ্বল স্বপ্ন কিছুটা হলেও শঙ্কার বোঝাটা হালকা করে দেয়। তাই ভাবা যেতেই পারে বঙ্গভঙ্গের উত্তাল সময়ে যে স্বদেশি আন্দোলন ছিল মূলত শহরকেন্দ্রিক, এ বার তাকে দেখা যাবে পরিপূর্ণভাবে, একেবারে গ্রাম-শহরব্যাপী। সস্তার চটকদারিতে ভুলে ঢের কেনা হয়েছে বিদেশি দ্রব্য। হয়তো এ বার শুরু হবে উল্টো পথে হাঁটা। হোক না একটু প্রযুক্তিতে দুর্বল, হোক না প্রাথমিকভাবে একটু বেশি মূল্যের, তবু দেশের কুকুর বিদেশের ঠাকুরের চেয়ে যে বেশি গ্রহণীয় তা হয়তো এ বার সাব্যস্ত হবে সর্বব্যাপী। সত্যজিৎ রায়ের অটোগ্রাফ খাতায় লেখা কবিতাটিও এই অসময়ে যেন এ রকমই আলো জ্বেলে দাঁড়িয়ে থাকে। রবীন্দ্রনাথের এ রকম অটোগ্রাফের কবিতা আরও আছে। রবীন্দ্রনাথের দু’ছত্র লেখা সমেত সই চেয়ে প্রতিদিন যে অজস্র অটোগ্রাফ খাতা আসত এবং রবীন্দ্রনাথ পূরণও করতেন সেইসব খাতায় ভক্তদের দাবি, সেগুলো তো কম নয়। তবে এর বেশিরভাগই হয়তো থেকে গেছে হদিশহীন ব্যক্তি-মানুষের সম্পত্তি হয়ে। রানী চন্দ লিখেছেন, ‘এই আমারই হাত দিয়ে কত অটোগ্রাফ-খাতা এসেছে গেছে কত লোকের। সে-সব কবিতা এমনিই চলে গেল। লিখে রাখিনি কখনো…অনুতাপ জাগে মনে ক্ষণে ক্ষণে।’
অটোগ্রাফের সব কবিতা সংগৃহীত হলে তা দিয়ে হয়তো একটা মূল্যবান সংকলনও হতে পারত। আর আমরাও হয়তো তাঁর জন্মদিনে সেই আলোয় এই ভাঙনকালের নিরাময়ের গল্পকে আরও একটু প্রসারিত করতে পারতাম। নানা ভাবেই তো রবীন্দ্রনাথকে দেখতে চায় বাঙালি। এখানেও হয়তো ভক্তের বারান্দা থেকে এক অন্য রবীন্দ্রনাথ উঠে এসে দাঁড়াতেন আমাদের সামনে।
তথ্যঋণ— ‘গুরুদেব’/রানী চন্দ, ‘যখন ছোট ছিলাম’/সত্যজিৎ রায়, ‘বুদ্ধদেব বসুর জীবন’/সমীর সেনগুপ্ত
ছবিটি গুগল থেকে নেওয়া।