কৌশিক গুড়িয়া
এখন ভোটের গরম। এমন গরম যতটা না ভোটারের তারচে অনেকাংশে বেশি ভোটতন্ত্রের অথবা ভোট-পুঁজিবাদীদের। সে গরমে শীত এ বার পালাবে পালাবে করছে; ঠিক যেমন ভাবে শৈশব আমাদের মানবজমিন থেকে খুব ধীরে, জাদু বাস্তবতার মোড়কে ভ্যানিশ হয়ে গেছে। তবে শৈশব উবে গেলেও শিশু-পাঠ্যের এক অলীক, মায়াময় জগৎ আমাদের মায়ের গায়ের গন্ধের মতো মনের মধ্যে লেপটে থেকে গেছে! যেমন করে থেকে গেছে কিশলয় বা সহজ পাঠ। তাই ১৯২৫-২৮ সালে রচিত সহজ পাঠ-কে আজ প্রায় একশো বছর পরেও সাম্প্রতিক ভোটের উত্তাপে সেঁকে নেওয়া যায়। একটু কঠিন করে বললে মনে প্রশ্ন আসে, রবি ঠাকুরকেও কি ভোটের উত্তাপে সেঁকে নেওয়া যায়? না, তাঁকে নয়। তবে ভোটের বাজারে রবীন্দ্রপ্রীতি অবশ্য সে তাপের খড়কুটো হতেই পারে। তাই রবিস্থানে পদার্পণ করেন লালনীলগেরুয়ার প্রতিভূরা, আর সেখানেই সদর্পে পথ আটকে দাঁড়ায় ভয় এবং বরাভয় …
#
আর আমরা যারা ছাপোষা, ভিতু ও ভোটার, তাদের মনের খাতায় থেকে যায় রবীন্দ্রনাথ ও নন্দলালের অমোঘ সেই যুগলবন্দি। সে নেশায় আবারও একবার প্রথম ভাগ ওলটাতে গিয়ে দেখি রবীন্দ্রনাথ আজকের রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ ভাবে জুড়ে না থাকলেও তাঁর প্রথম ভাগের দ্বিতীয় পাঠ, পৃষ্ঠা ২৭ যেন আজকের ভারতীয় গণতান্ত্রিক মহাযুদ্ধের এক চাক্ষুষ বিবরণ! কিন্তু কেন মনে হল এমন কথা, তা স্পষ্ট করে বলার আগেই মনে করিয়ে দিই যে, সহজ পাঠের প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ বিশ্বভারতীর গ্রন্থালয় থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৩০ সালের ১০ মে। অর্থাৎ, শ্রেষ্ঠ এই বাংলা প্রাইমারের রচনাকাল অবশ্যই শতাধিক বছরের পুরনো। যে পৌরাণিকতার ধারে কাছেও আসে না বঙ্গ বা রাষ্ট্রের প্রধান, অপ্রধান কিংবা বিন্দুমাত্র অনেক রাজনৈতিক দল!
#
২৭ পৃষ্ঠায় দ্বিতীয় পাঠ (সহজ পাঠ প্রথম ভাগ, ২০০৫ পুনর্মুদ্রণ) শুরু হচ্ছে, ‘রাম বনে ফুল পাড়ে…’ এই বাক্য দিয়ে। শ্রীরাম নামক শব্দটি আজ রাজনৈতিক নাকি আধ্যাত্মিক অনুষঙ্গ সে বিতর্কে না গিয়েও বলা যায় সাম্প্রতিক রাম-চর্চা অবশ্যই গুরুদেবের বিষয় ছিল না। কিন্তু দূর ও দৃষ্টির মধ্যিখানে কতটা চাষ জমি ছিল, এ কথা হলফ করে বলাই যায়। আমি আবারও পড়ছি শুনুন, ‘গায়ে তার লাল শাল। হাতে তার সাজি। … … তার বাড়ি আজ পূজা। … … ঢাক বাজে, ঢোল বাজে’। এমন বাদ্যির আড়ালেই কি মিহি কোনও চড়াম চড়াম ধ্বনি ভেসে আসছে? আসুক ছাই না আসুক, তবে সে সবের ক্লাইম্যাক্স নিশ্চিত ভাবেই রচনা করেছে সহজ পাঠে বর্ণিত গৃহকর্তা বা বালকের ‘লাল শাল’। যে রং আজ কেবল বহু দূরাগত এক প্রত্ন-সিগন্যাল মাত্র!
কী সেই ঘোর, ভয়ঙ্কর খেলা! পাঠ যতই সহজ হোক! তার অনুধাবন-সম্ভাবনাকে এতখানি কঠিন করে গেলেন কেন গুরুদেব?