সুদর্শন মণ্ডল
ভোট এক গণতান্ত্রিক উৎসব। এ উৎসবে অনেকের মতো আমিও শামিল হয়েছিলাম এ বার। ভোটের আগের দিন সকাল সকাল ব্যাগপত্তর নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম ডিসিআরসি-র উদ্দেশে। মনে কেঁচোর মতো কিলবিল করছিল ভয়। কী হয়, কী হয় ভাব।
এ বার আমাদের ভোটের যাবতীয় জিনিস সংগ্রহ করতে হল কল্যাণী মহাবিদ্যালয় থেকে। মানে এ বারের ডিসিআরসি কল্যাণী মহাবিদ্যালয়। সেখানে গিয়ে বাধল গোল। আর গোল বাধবে নাই বা কেন? তিনটে বিধানসভার মেটিরিয়াল সংগ্রহ করার স্থান যে এই কলেজ! যদিও পরপর অলাদা রঙের প্যান্ডেল করে বিধানসভাগুলোকে চেনার ব্যবস্থা করা আছে। তবুও সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া গেল না।
যাইহোক আমরা নীল রঙের প্যান্ডেল দিয়ে ঘেরা হরিণঘাটা বিধানসভার জন্য নির্দিষ্ট কক্ষে প্রবেশ করলাম। চারদিকে তখন মেলার মতো লোক গিজগিজ করছে। অনেকটা কুম্ভ মেলার মতো। দেখে মনে হচ্ছে ভোটকর্মীরা মহান পূণ্য অর্জনের জন্য মিলিত হয়েছেন ত্রিবেণীতে। এক্ষুনি ঝাঁপ দেবেন গঙ্গা, যমুনা আর সরস্বতীর মিলনস্থলে। এ সব দেখে কে বলবে করোনা আবহ চলছে বিশ্বে আর প্রতিদিন অজস্র লোক মারা যাচ্ছেন মারণ ভাইরাসে!
আমি একটু বেশিই ভীতু। যতটা না ভোট নিয়ে ভয় পাচ্ছি, তার চেয়ে বেশি ভয় পাচ্ছি করোনা নিয়ে। যদিও আমার করোনার দুটো ডোজই নেওয়া আছে, তবু সাবধানতা অবলম্বন না করলে ইঞ্জেকশন কী করবে! যে দিকেই তাকাই সে দিকেই সন্দেহের দৃষ্টি। হয়তো তা আমারই কোনও সহকর্মীর উপর। আশেপাশের লোকেরা যখনই হাঁচি দিচ্ছে, মনের কোনে এক অজানা সতর্ক চাহনি এসে হাজির হচ্ছে। এই বুঝি ভাইরাস আমার শরীরে প্রবেশ করল!
ডিসিআরসিতে ঢুকেই তাই গোয়েন্দার মতো খুঁজে চলেছি, কার কার সর্দি কাশি আছে। পোলিং মেটিরিয়াল নেওয়ার দিকে যেন এতটুকু নজর নেই। সব নজর করোনা রোগী খোঁজার দিকে, বন্দুকের নলের মতো তাক করে আছে আমার মন। খুব সহজে ভোটের জিনিস সংগ্রহ করা গেল না। টিমের এক পোলিং অফিসার গরহাজির। অপর একজনকে ট্যাগ করতে হবে। ট্যাগ করতে গিয়ে জানতে পারি ১২টার আগে কোনও অফিসারকে ট্যাগ করানো হবে না। অগত্যা তীর্থের কাকের মতো বসে থাকা।
অনেক কষ্টে আমাদের টিম রেডি করা গেল। এ বারে বাসে ওঠার পালা। বাসে উঠে দেখি আর এক সমস্যা। সব টিম এখনও বাসে ওঠেনি। আমাদের বাসে মোট ছ’টি টিমের যাওয়ার কথা। চারটি টিম এসেছে। এখনও দুটো টিমের বাসে ওঠা বাকি। ফলে অপেক্ষা অন্য টিমের জন্য। বেশ কিছুক্ষণ পরে বাসে সব টিম উঠল। বাস নিল তার গতি।
পোলিং বুথে যখন পৌঁছলাম সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে ঘুমিয়ে পড়েছে। বড় হাইস্কুলে চারটি বুথ। আধা সামরিক বাহিনী আগেই ওখানে মজুত ছিল। ফলে সুরক্ষার ব্যাপারে অনেকটা নিশ্চিন্তই ছিলাম। ভোটের আগের দিন যা যা কাজ থাকে তা শেষ করতে প্রায় রাত ১২টা বেজে গেল। আমি দুটো স্টুডেন্ট বেঞ্চ পাশাপাশি রেখে শুয়ে পড়লাম। বেঞ্চের নীচে মশা মারার ধূপ জ্বলছে। ঘরের কোণে কার্বলিক অ্যাসিড রাখা। তবুও নিশ্চিন্তে ঘুম হল না। রাতে বোমার আওয়াজে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে বারবার।
ভোর ৪টের সময় উঠে পড়তে হল। মুখ হাত পা ধুয়ে স্নান সেরে শুরু হল ভোটের দিনের যাবতীয় কাজ। মক-পোল চলছে বুথের ভিতরে। বাইরে তখন জনতার লাইন। লাইন সামলাতে ব্যস্ত আধাসামরিকের দল। মক-পোল শেষে জনগণ তাঁদের অধিকার প্রয়োগ করতে লাগলেন শান্ত ভাবেই। বড় বিচিত্র এই জনগণ। আমরা সকলেই জানি, ভোট দিতে এসে পরিচয়পত্র দেখানো বাধ্যতামূলক। কিন্তু বেশ কিছু ভোটার সেই পরিচয়পত্র দেখাতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন পোলিং অফিসারের কাছে। সম্ভবত তাঁরা ভাবছেন, তাঁর জলজ্যান্ত শরীরটাই তো পরিচয়, তাহলে খামোখা একটা কাগজ দেখানোর কী প্রয়োজন। আসলে তাঁরা জানেন না, শরীর থাক আর যাক, আসল পরিচয় তো ওই কাগজ। ওটি না থাকলে যে শরীর থাকলেও কখন কখন নেই হয়ে যায়। তাই সশরীরে ভোট দিতে এলেও পরিচয় পত্র ‘মাস্ট’।
বুথে যাঁরা পোলিং এজেন্ট ছিলেন, সকলেই বেশ সহযোগিতা করেছেন। লাইনেও কোনও গন্ডগোল হয়নি। দেখে মনে হচ্ছিল, ভোট তো এরকমই হওয়া উচিত! ভোট শেষে ফিরে আসার পালা। সমস্ত জিনিস জমা দেওয়ার সময় এসেছে। সব কিছু বুঝিয়ে দেওয়ার পরে ঘড়ির দিকে তাকানোর একটু সময় পাওয়া গেল। ঘড়ির কাঁটা বলছে রাত ১১টা ৫০। বুঝলাম, বাড়ি ফিরতে ভোর হয়ে যাবে। এতক্ষণ শরীরের দিকে নজরই দেওয়া হয়নি। যেন একটা ঝড় বয়ে গেল আমাদের শরীরের উপর দিয়ে। মাথা প্রচণ্ড ধরেছে বলে মনে হচ্ছে। সারা গায়ে ব্যথা। ফোন করলাম বাড়িতে।
(ফিচার ছবি গুগল থেকে নেওয়া)