সারথি বিশ্বাস

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘কাব্যে উপেক্ষিতা’-দের পরম সমাদরে তুলে এনেছিলেন। বাল্মীকির ঊর্মিলা, কালিদাসের অনসূয়া, প্রিয়ংবদা আর বাণভট্টের পত্রলেখাকে তাদের অধিকার দিয়েছিলেন, অস্তিত্ব দিয়েছিলেন।
কেবল এই তিন জন নন, এবং কেবল কাব্যেই নয়, নারীরা সর্বত্র উপেক্ষিত হয়, উপেক্ষাই তাদের সমস্ত যাপন জুড়ে থাকে। দেশে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কালে, ভোটাধিকার প্রয়োগের সময় নারীরা ধর্তব্যের মধ্যেই আসেনি প্রথমে। নারীর গণতান্ত্রিক অধিকার সোজা পথে হাঁটেনি, তাকে ছিনিয়ে আনতে হয়েছে। নারীর ভোটাধিকারকে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি মুক্তহস্তে দেয়নি কেউ, তা আদায় করতে হয়েছে। ‘মানুষের’ ভোটাধিকারের সঙ্গে সঙ্গেই এইসব ‘না-মানুষেরা’ ভোটাধিকার পায়নি কিন্তু!
আর, তা পাওয়ার পরেও সেই ভোটকে আলাদা কোনও গুরুত্ব দেওয়া হয়নি দীর্ঘকাল। নারীর আলাদা শরীর তো আছে কিন্তু সেই শরীরের উপর তার নিজের কোনও অধিকার নেই। আলাদা কোনও ইচ্ছে নেই। নারী আসলে পুরুষের সত্তায় বিলীন, পুরুষের ছায়া মাত্র। তাই বাড়ির পুরুষ-ভোট যে বাক্সে ঢোকে, ছায়া-ভোটও সেই বাক্সে ঢুকবে— এটাই আমাদের দেশের নারীর ভোটাধিকারের আসল চেহারা। নারীর ভোট পাওয়ার জন্য আলাদা করে কোনও পরিশ্রম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের করতে দেখা যেত না তাই। সে প্রয়োজনও পড়েনি নিশ্চয়ই।
অনেক নেতিবাচক চিত্র-চিহ্নের মাঝেও পশ্চিমবঙ্গের এ বারের বিধানসভা নির্বাচন এদিক থেকে ইতিবাচক। ‘রাজনীতি’-ই সই, কিন্তু করতে তো হচ্ছে। উপেক্ষা যে আর করা যাচ্ছে না, এটা স্পষ্ট। তাই তো নির্বাচনী প্রচারে, ইস্তাহারে মেয়েদের জন্য প্রতিশ্রুতির ছড়াছড়ি। বাড়ির পুরুষের ভোট পেলেই মেয়েদের ভোট পিছুপিছু হেঁটে আসবে, এই ধারণা ভুল প্রমাণ হচ্ছে বোধহয়। তাই, ভোটের জন্য নারীদের উদ্দেশে ভেট চড়াতে হচ্ছে। কোনও রাজনৈতিক দল বলছে, ক্ষমতায় এলে মেয়েদের ‘হাতখরচ’ দেওয়া হবে, কোনও পার্টি সরকারি চাকরিতে মেয়েদের ৩৩ শতাংশ সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, কোনও দল বলছে, সরকারি প্রকল্পে নিযুক্ত মেয়েদের পারিশ্রমিক বাড়াবে। সবটাই হবে যদি মেয়েরা তাদের ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনে।
কার প্রতিশ্রুতি কতখানি বাস্তব, কারটা কতখানি সত্যি হবে, এ তো তর্কসাপেক্ষ এবং সময়সাপেক্ষ। সময়ই বলুক। যদিও, বৈষম্য, অমর্যাদা, নির্যাতন নিত্যপ্রাপ্তি মেয়েদের, তবুও, এটুকু বলার, মেয়েদের জন্য ক’টা পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে, ক’টা প্রকল্পে কত কোটি খরচ হবে, কিংবা আদৌ হবে কিনা, সেটা বড় কথা নয়। আপাতত, বড় কথা হল মেয়েদের জন্য কিছু কথা তো অন্তত খরচ করতে হচ্ছে! বলতে তো হচ্ছে, ‘এ বার মহিলা, এ বার…।’

(ফিচার ছবি গুগল থেকে নেওয়া)