সুদীপ জোয়ারদার
—‘ভালো সাঁতার জানেন তো?’
—‘গ্রামের ছেলে, পুকুরে স্নান করেই বড় হয়েছি, সাঁতার জানব না তাই হয়?’
—‘কিন্তু পুকুর আর ভাগীরথী তো এক নয়!’
—‘ও কিছু হবে না। এত কাছে নদী, নদী ছেড়ে, কলে কে স্নান করে!’ বলেই গায়ে গামছা জড়িয়ে নেন ফার্স্ট পোলিং অফিসার। বেলা ১২টা। বুথে ভিড় নেই, ওঁর কাজটা আমি কিছুক্ষণের জন্য হয়তো সামলে দিতে পারব। কিন্তু বলা যায় না, স্নান করতে গিয়ে যদি কিছু অঘটন…
প্রবল চিন্তায় পড়ে যাই আমি। এ বারের বিধানসভা ভোটে বহরমপুরের কাছাকাছি শহর এলাকাতে আমার বুথ পড়েছে দেখে খানিকটা চিন্তামুক্ত হয়েছিলাম। তার উপর, ডিসিতে গিয়ে যখন দেখলাম, সংলগ্ন বুথে রয়েছেন আমার স্কুলের সবার প্রিয় এক সহকর্মী, তখন আনন্দিতও হয়েছিলাম বেশ। কিন্তু বিষয়টা ভোট। টেনশন যে কোথা দিয়ে চলে আসে!
ভোটকর্মী-বন্ধুটিকে বারণও করতে পারছি না। একে চেনা মানুষ। তার উপর শান্ত বুথ। লোকজন, এজেন্ট সকলেই ভাল। পাশাপাশি দু’টি বুথের জন্য আধাসামরিক বাহিনীর সশস্ত্র জওয়ানও অনেক ক’জন। ভোট চলছে মসৃণ ভাবে। এই অবস্থায় মিনিট পনেরো স্নানের জন্য তিনি তো নিতেই পারেন! কিন্তু স্নানটি যে যেখানে সেখানে নয়!
বুথের মিটার কুড়ি দূর দিয়ে বয়ে চলেছে ভাগীরথী। জানলা দিয়ে চেয়ে চেয়ে দেখি, নিয়ামতভাই (নাম পরিবর্তিত) গুটিগুটি পায়ে আমার বুকে কাঁপন ধরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন সেদিকে…
‘নদীর ধারে বাস/ ভাবনা বারো মাস।’ গতকাল রাতে প্রায় পাখা-না থাকা বুথে (একটিই পাখা, তাও সিলিং নয়, দেওয়াল-পাখা) আমরা কয়েকজন ভোটকর্মী মশা আর গরমে যে ভাবে নাজেহাল হয়েছি, তাতে গরমের জন্য না হলেও অত বড় বড় মশা তো নদীরই কারণে! তার উপর আজ এই চিন্তা। দেড় দিনের বসবাস, এতেই নদী যেন বুঝিয়ে ছাড়বে, প্রবাদ এমনি এমনি গড়ে ওঠে না!
হঠাৎ খেয়াল হল, বুথে ভোটার ঢুকছে না বেশ কিছুক্ষণ। উঁকি মেরে দেখি, চারদিক সুনসান। ব্যাপার কী? একজন এজেন্ট খোলসা করেন, ‘‘রোদ না পড়লে কেউ আর আসবে না স্যর!’’
গতকাল রাতে ঘুম হয়নি একটুও। তার উপর, কাল সকাল থেকেই নাকে দু’-দু’খান মাস্ক। মাথার দু’পাশে রগ দুটো টিপটিপ করছে। চোখ কিছুক্ষণ বন্ধ করলে একটু আরাম হত। কিন্তু সে উপায় নেই। বেশি কাজ হলে, লোকে বলে ভূতের খাটনি। ভূত কেমন খাটতে পারে আমরা কেউ জানি না। তবে মনে হয়, ভূতেদের বেশি খাটনি হলে ওরা হয়তো বলে, ‘‘এ যে ভোটের খাটনি!’’
ফর্ম আর খাম যে কত ধরনের হতে পারে ভোট যাঁরা না করেছেন তাঁরা ধারণাও করতে পারবেন না। সে সব পূর্ণ করার কাজ গত রাতে চার জনে মিলে কিছুটা সেরে রেখেছিলাম। কিন্তু অনেক কাজই রয়েছে, যেগুলো ভোট শুরু না হলে করা যায় না।
ভোট চলতে চলতে যেগুলো সারা যায় সেগুলোই সারছি সকাল থেকে। আর এখন বুথ ফাঁকা। এই সুযোগটাকে কাজে তো লাগাতেই হবে, তা সে যতই মাথা ধরুক। একটা মাথা ধরার ওষুধ অ্যান্টাসিড সহযোগে খেয়ে লেগে যাই কাজগুলো নিয়ে।
তিন দলের এজেন্টের মধ্যে বেজায় সদ্ভাব। প্রতি দলের দু’জন করে এজেন্ট, পালটে পালটে আসছেন। কোনও রেষারেষি, বিতণ্ডা তো নেইই বরং নিজেদের মধ্যে সবাই গল্প করছেন খোশমেজাজে। কাজ সারতে সারতে ওঁদের গল্পের কিছু কিছু আমার কানেও আসছে। এই সময় মাঝের দলের এজেন্ট হিসাবে বসেছেন এক তরুণ। বুথ ফাঁকা দেখে পাশে বসা বয়স্ক এজেন্টটি এ বারের ভোটে তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ দলের তরুণ এজেন্টের উদ্দেশে বলেন, ‘‘এই ফটকে, এক বোতল জলে এই ওআরএস গোল না! খাই সবাই মিলে।’’
ওআরএসটা আমারই দেওয়া। কাজ করতে করতে দেখি তার সদ্ব্যবহার। তরুণের তৈরি ওআরএস-জলে একে একে গলা ভিজিয়ে নিচ্ছেন তিন দলেরই এজেন্ট। কে বলে সবার উপরে দল সত্য! মন ভরে যায়।
এ দিকে ওঁদের ওআরএস-জল খাওয়ার মাঝখানে ফার্স্ট পোলিং স্নান সেরে ফিরে এসেছেন। কিছুক্ষণ পরে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর দুপুরের খাবার আসে। বুথ ফাঁকা দেখে দু’জন দু’জন করে বসে যাই খেতে।
এজেন্টরা বলেছিলেন, রোদ পড়লে ভোটার আসবে। খাবার পরেই কিন্তু ভোটার আসতে থাকে দু’চার জন করে। ভোট চলছে, আমার ফর্ম পূরণের কাজ-সহ অন্য কাজও চলছে। ৫টার পরে আর ভোটার নেই। কিন্তু সাড়ে ৬টা পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতেই হবে। নিয়ম।
সাড় ৬টায় ভোট শেষ করে করে হিসেবপত্তর, লেখালেখি নিয়ে বসে যাই। আমার সঙ্গী ভোটকর্মী বন্ধুরা সকালে মক-পোল, মেশিন সিলিং সামলেছেন দক্ষ হাতে। এতক্ষণ গরমে নিজেদের কাজগুলোও করছেন সুষ্ঠু ভাবে। ভোট শেষের পর মেশিন সিলিং, বাঁধাছাঁদার কাজটাও তাঁরাই করেন ক্ষিপ্র গতিতে। আমি কাগজ সারতে থাকি।
সব কিছু নিয়ে রিসিভিং সেন্টারে এসে দেখি আগের দিনের মতোই তিল ধারণের জায়গা নেই। করোনা বলে যে কিছু আছে, এখানে সেটা বোঝা দায়। কর্তৃপক্ষের ‘সচেতনতা’ও চমৎকার! কোভিডকালে ডিসিআরসির জায়গা কিছুটা বড় আশা করেছিলাম। সেটা তো নেই-ই, উপরন্তু জিনিসপত্র জমা দেওয়া এবং নেওয়া বুথের সংখ্যা বেশিরভাগ কাউন্টারেই বেড়ে গিয়েছে। দৌড়ে গিয়ে, লাইন পেলাম ছ’টি পোলিং পার্টির পরে।
কী ভাবে জিনিসপত্র জমা নেওয়া হবে সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেও বলা হয় না কোনও বার। ট্রেনিংয়ে বলা কথা এবং ভোট-বইয়ের লেখার সঙ্গে মেলার তো প্রশ্নই ওঠে না। এক বয়স্ক ভদ্রলোক জমা দিতে গিয়ে কাউন্টারের চাহিদায় নাকাল হয়ে বলেন, ‘‘রিসিভিং সেন্টার না রগড়ানো সেন্টার!’’
কাউন্টারের মানুষটি রাগেন না, হেসে ফেলেন। এত ক্লান্তির মাঝেও তাঁর এই হাসিটা বেশ লাগে। জমা দেওয়ার লাইনে দাঁড়িয়ে ঘামতে ঘামতেও মনে হয় ভোট শুধু খাটনি আর দুশ্চিন্তার নয়। অন্য কিছু প্রাপ্তিরও।
(ফিচার ছবি গুগল থেকে নেওয়া)
(ভোটের ডিউটিতে গিয়ে কেমন হল আপনার অভিজ্ঞতা, ৬০০-৭০০ শব্দের মধ্যে লিখে পাঠান এই মেলে— sadakalonewz@gmail.com। নির্বাচিত লেখা প্রকাশিত হবে আমাদের নিউজ পোর্টালে (sadakalo.in)। সঙ্গে নিজের ছবি ও ফোন নম্বর পাঠাতে ভুলবেন না)