দীপক সাহা

বিরোধীদের মুখে ছাই দিয়ে ‘দুয়ারে সরকার’ ফের নবান্নের দুয়ারে। প্রতিপক্ষ যতই শক্তিধর হোক, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আবার প্রমাণ করে দিলেন যে, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তিনি এখনও অপরাজেয়, অপ্রতিরোধ্য।
গত লোকসভা ভোটে রাজ্যে বিজেপি অভাবনীয় সাড়া জাগিয়ে এ বারে বিধানসভা নির্বাচনে নবান্ন দখল করতে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা-সহ তাবড় নেতানেত্রী রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে নির্বাচনী প্রচারে সুনামির ঢেউ তুলেছিলেন। কিন্তু তবুও ভোটের লড়াইয়ে এঁটে উঠতে পারেননি পায়ে চোট পেয়ে হুইলচেয়ারে বসে প্রচারাভিযান চালানো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। খেলা শেষে বাংলার মসনদ গেরুয়া বাহিনীর অধরাই রইল এ বারেও।
জাতীয়তাবাদী হিন্দুত্বের জিগির তুলে বাংলা দখল করতে চেয়েছিল আরএসএসের মুখ, বিজেপি। প্রতিটি নির্বাচনী জনসভায় বাঙালির মনে জায়গা পাওয়ার জন্য বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বাঙালি মনীষীদের নাম ও তাঁদের বাণী মুখস্থ করে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন বাংলার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও পরম্পরার প্রতি তাঁরা খুবই শ্রদ্ধাশীল। ‘অব কি বার, দোশো পার’— বিজেপির সর্বোচ্চ নেতাদের এই গালভরা স্লোগানের প্রতিচ্ছবি বাস্তবে একশোর ধারেকাছেও নেই। ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস’— কথায় ও কাজে আকাশপাতাল অমিল। তাই বিজেপির মেকি স্লোগানে প্রলুব্ধ না হয়ে বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পীঠস্থান বঙ্গভূমিতে সাম্প্রদায়িক শক্তির আস্ফালনকে প্রতিহত করতে ইভিএমে জবাব দিয়েছে সংস্কৃতিপ্রেমী ও সাম্প্রদায়িক মূল্যবোধসম্পন্ন বাংলার সচেতন নাগরিক। দিল্লির বাঘা বাঘা নেতারা বাংলার মানুষের পালস্ বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন।
মমতার বিরুদ্ধে ‘সংখ্যালঘু তোষণের’ অভিযোগ এনে বিজেপি রাজনৈতিক মেরুকরণের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ৩০-৭০ বিভাজিত সূত্রে বৃহত্তর সচেতন বাঙালি সমাজ দিগভ্রান্ত হয়নি। সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পকে নস্যাৎ করে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায় এককাট্টা হয়ে জোড়াফুলকে আলিঙ্গন করেছে। কাশ্মীর ইস্যু, ৩৭০ ধারা রদ, রাম মন্দির নির্মাণ, তিন তালাক ইস্যু এবং সর্বোপরি সিএএ ও এনআরসি ইস্যুতে লড়াইয়ের ময়দানে মুসলিম সম্প্রদায় মমতাকেই তাদের একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবাদী মুখ মনে করেছে। উপরিউক্ত ইস্যুগুলোর জন্য আতঙ্কিত, ভীত, সন্ত্রস্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল। তাদের রাতের ঘুম উবে গিয়েছিল। পরিত্রাণের পথ খুঁজছিল। সদ্য রাজনীতির অলিন্দে পা রাখা আইএসএফ বা হায়দারাবাদের মিম বা বাম অথবা কংগ্রেসকে নয়, তারা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেছে অস্তিত্বের লড়াইয়ে, বাঁচার প্রশ্নে জোড়াফুলই তাদের একমাত্র ভরসার জায়গা। তাই বিভেদকামী শক্তির আস্ফালনে মমতার আঁচল তাদের কাছে বটবৃক্ষ স্বরূপ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তি-ইমেজই তৃণমূলের মূল শক্তি। তাঁর আটপৌরে ব্যাপারটাই মানুষ পছন্দ করেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাফল্যের কারণ নেতৃত্ব দেওয়ার সহজাত গুণ, আর মানুষ তাঁকে দূরের নয়, পাশের বাড়ির মেয়ের মতো নিকটজন হিসেবে দেখে।
অন্যদিকে বিজেপি সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরুর বিষাক্ত বিভাজনের যে তাস খেলেছিল তাকেও সংখ্যাগুরুর বৃহত্তর অংশ মান্যতা দেয়নি। হ্যাঁ, এটা ঠিক কাটমানি, আমফানের দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, কর্মসংস্থানের মতো নানা ক্ষেত্রে তৃণমূল কংগ্রেসের ভূমিকায় সাধারণ মানুষ বীতশ্রদ্ধ। কিন্তু বাঙালির অস্মিতা রক্ষার জন্য এই সমস্ত ইস্যুগুলো এ বারের নির্বাচনে প্রথম সারিতে গুরুত্ব পায়নি। বাঙালির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, পরম্পরা, সর্বোপরি বাংলা ভাষা হুমকির মুখে পড়তে চলেছে হিন্দি বলয়ের আগ্রাসনে। এই আশঙ্কায় জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সামনে রেখে লড়তে চেয়েছে।
বাংলা দখলের উদ্দেশ্য নিয়ে যাঁরা ভিনরাজ্য থেকে এসে পরিযায়ী পাখির মতো বঙ্গভূমিতে তাঁবু খাটিয়েছিলেন তাঁদের বাঙালির সভ্যতা, সংস্কৃতি, ভাষা, এমনকি খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কেও সম্যক কোনও ধারণা ছিল না। ‘সোনার বাংলা’ গড়ার ডাক দিয়ে বাংলায় ‘আসল পরিবর্তন’ আনার লক্ষ্যে বিজেপি সাধারণ মানুষকে বোঝানোর জন্য আদাজল খেয়ে নির্বাচনী প্রচারে ঝড় তুলেছিল। কিন্তু মানুষ তাদের বক্তব্যকে আমল দেয়নি। ভোটের প্রাক্কালে দলবদলুদের সুবিধাবাদী চরিত্রকে বাংলার সাধারণ ভোটাররা ভালো চোখে দেখেনি। উপরন্তু প্রতিটি জনসভায় দলবদলু এক নেতার মমতাকে ‘বেগম’, ‘ফুপু’ ইত্যাদি অপমানজনক সম্বোধনে বেজায় অখুশি ছিল বাংলার মানুষ। মমতাকে প্রধানমন্ত্রীর ‘দিদি, ও…ও…ও… দিদি’— ব্যঙ্গাত্মক এই সম্ভাষণও মানুষ, বিশেষ করে বাঙালি মেয়েরা ঘৃণার চোখে দেখেছে। ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি শান্তিপ্রিয় বাঙালির মননে হিল্লোল তোলেনি বরং বিদ্বেষ জাগরিত করেছে। অবাঙালি বিজেপির নেতাদের বাংলার গরিব কৃষক, শ্রমিকদের ঘরে মধ্যাহ্ন ভোজনের নাটক স্যোশাল মিডিয়ায় শেয়ার হলেও ইভিএম স্পর্শ করেনি। সর্বোপরি বাংলার ঘরের মেয়ে মমতাকে টক্কর দেওয়া মতো কোনও মুখ বিজেপি সামনে আনতে ব্যর্থ হয়েছে।
বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতির মধ্যে যে বহুমাত্রিক সৌকর্য রয়েছে, তা বিভেদকামী শক্তিকে পরাস্ত করেছে। বিশ্বাস করি, অপশক্তি যতই চেষ্টা করুক, নিরাপত্তাহীনতা যতই বেড়াজাল সৃষ্টি করুক, আমাদের চেতনাই আমাদের সৌহার্দ্যপূর্ণ অবস্থানকে সঙ্কুচিত করতে পারবে না। কিন্তু এর মধ্যেও অশনিসঙ্কেত উঁকিঝুঁকি মারছে। বিধানসভা নির্বাচন পরবর্তীতে রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় রাজনৈতিক হিংসা, প্রতিহিংসার ঘটনা ঘটছে। রক্তক্ষয় হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিয়েই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছেন, যারা হিংসা ছড়াচ্ছে বা হিংসায় ইন্ধন দিচ্ছে তাদের কোন মতেই রেয়াত করবেন না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস রাজনীতির সঙ্কীর্ণ গণ্ডীকে অতিক্রম করে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী কড়া হাতে পরিস্থিতির মোকাবিলা করবেন। আগামী সকালে বাংলার মাটি আর কোনও রাজনৈতিক হিংসার রক্তে রঞ্জিত হবে না এই প্রত্যাশা রাখি।

(ফিচার ছবি গুগল থেকে নেওয়া)