দীপক সাহা

হাসপাতালে শয্যা নেই, বাঁচার জন্য ওষুধ নেই, শ্বাস নেওয়ার জন্য অক্সিজেন নেই। এমনকি মৃত্যুর পরেও শ্মশান বা কবরেও ঠাঁই নেই। ঘাটে শেয়াল-কুকুর, নদীতে ভাসমান লাশ, আকাশে চিল-শকুনের আনাগোনা। বিভীষিকা মৃত্যু গ্রাস করছে একের পর এক মানুষকে। ধীরে ধীরে এই বিশাল মৃত্যু মিছিলে যোগ দিচ্ছে চেনা-অচেনা নানা মুখ। কেউ হারাচ্ছেন তাঁর প্রিয়জন তো কোথাও শেষ হয়ে যাচ্ছে একটা গোটা পরিবার। যত দিন যাচ্ছে ততই করোনা মারাত্মক আকার ধারণ করছে। গোটা দেশের মতো আমাদের রাজ্যেও ছবিটা একই রকম।
টিকা নিলে কিছুটা হলেও এই রোগের প্রকোপ কম হচ্ছে, জানাচ্ছেন চিকিৎসকরা। এর ফলে বর্তমানে এখন চাহিদা বেড়েছে টিকার। টিকার লাইনে অজস্র মানুষের ভিড় চোখে পড়ার মতো। কিন্তু টিকার দেখা নেই। হন্যে হয়ে মানুষ টিকার খোঁজ করে বেড়াচ্ছে। অন্যদিকে এই সঙ্কটকালে অক্সিজেনের বিরাট শূন্যতা দেখা দিয়েছে। তাই এই শূন্যতা পূরণ করতে বিদেশ থেকে আনা হচ্ছে অক্সিজেন এবং ভ্যাকসিন। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা যৎসামান্য। এরই মাঝে গোদের উপর বিষফোঁড়া, কালোবাজারি। মানুষ যখন বিপদে, তখন মনুষ্যত্ব ভুলে বেশি মুনাফা লুট করার চেষ্টায় ব্যস্ত এক শ্রেণির মানুষ। কোভিড পরিস্থিতিতে অসহায়তার সুযোগ নিয়ে একাধিক পরিবারকে সর্বস্বান্ত করে চলেছে কিছু জালিয়াতি চক্র।

এরই মাঝে গোদের উপর বিষফোঁড়া, কালোবাজারি। মানুষ যখন বিপদে, তখন মনুষ্যত্ব ভুলে বেশি মুনাফা লুট করার চেষ্টায় ব্যস্ত এক শ্রেণির মানুষ। কোভিড পরিস্থিতিতে অসহায়তার সুযোগ নিয়ে একাধিক পরিবারকে সর্বস্বান্ত করে চলেছে কিছু জালিয়াতি চক্র।

একটু সাহায্যের আশায় সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের অসহায়তা ও প্রয়োজন তুলে ধরছেন রোগী ও রোগীর আত্মীয়েরা। আর সেইসব সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টের জবাবে সাহায্যের নাম করে এগিয়ে আসছে একদল কালো হাত। আর সাহায্যের আশ্বাস দিয়ে ঠকিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। অনলাইন পেমেন্টে টাকা পেয়ে যাওয়ার পরে আর দেখা পাওয়া যাচ্ছে না সেইসব ভুয়ো ‘সাহায্যকারী’-দের। আবার কোনও সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় ফোন নম্বর দিয়ে পাতা হচ্ছে ফাঁদ। কখনও চিরকুটের মাধ্যমেও হাতে হাতে ঘুরছে নানা ফোন নম্বর। সেখানে ফোন করলে ভেসে আসছে অজানা কণ্ঠস্বর, ‘রেমডিসিভি চান? পাবেন, তবে বেশি টাকা লাগবে, রাজি আছেন?’ এই ফাঁদে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হচ্ছেন বহু মানুষ। বাজার থেকে উধাও করে দিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম চাহিদা বাড়াচ্ছে জীবনদায়ী ওষুধের।
অ্যাম্বুল্যান্সের ভাড়াও আকাশছোঁয়া। অক্সিমিটার তিন-চার গুণ দামে মিলছে। এ দিকে মৃত্যুর মিছিল চলছে অক্সিজেনের অভাবে। স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও নার্সিংহোমগুলিতে অভাব দেখা দিচ্ছে অক্সিজেনের। রোগীকে নিয়ে পাগলের মতো এখানে ওখানে ঘুরতে হচ্ছে রোগীর পরিবারকে। সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে শুধুই অক্সিজেনের হাহাকার। বেশ কিছু ক্ষেত্রে দ্বিগুণ বা তিনগুণ বেশি দামে মিলছে অক্সিজেন সিলিন্ডার। অক্সিজেন-সহ বেডের আকাল তৈরি হয়েছে বহু হাসপাতালে। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় অবস্থা তীব্র সঙ্কটজনক। খুব গোপনে ইতিউতি অনেক বেশি দামের অক্সিজেন ক্যানের সন্ধান মিলছে ফোনের মাধ্যমেই। করোনায় যখন রাজ্যের মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন তখন পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সাহায্যের নাম করে প্রতারণার ফাঁদ পাতা হচ্ছে। ফোন করলে অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছে দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সেই নম্বরগুলিতে ফোন করে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন অনেকেই। অভিযোগ, অসাধু ব্যবসায়ীদের একাংশ সিলিন্ডার মজুত করে রাখছেন ও সুযোগ বুঝে চড়া দামে বিক্রি করছেন। কালোবাজারির অভিযোগ উঠেছে অক্সিজেন সিলিন্ডারের অপরিহার্য যন্ত্রাংশ ফ্লো-মিটার নিয়ে। খাস কলকাতায় দাম চাওয়া হচ্ছে প্রায় ১০ গুণ।
করোনা চিকিৎসায় সাধারণভাবে গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ সরবরাহের দায় নেওয়ার কথা হাসপাতাল বা নার্সংহোমের। অভিযোগ, অনেক সময়ই সেই দায় ঝেড়ে ফেলছে তারা। কোনও চিকিৎসাকেন্দ্রে ভর্তি রোগীর জন্য রেমডেসিভি বা টসিলিজুমাবের দরকার হলে সেটা চিকিৎসাকেন্দ্র থেকেই দেওয়ার কথা। কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই রোগীর পরিবারকেই ওষুধটি জোগাড় করতে বলে একটি রিক্যুইজিশন স্লিপ ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এরপরেই শুরু হচ্ছে রোগীর পরিজনদের উদভ্রান্তের মতো ছোটাছুটি— কোথায় মিলবে এই ওষুধ। এই পরিস্থিতিতেই আড়ালে-আবডালে ‘সহায়তা’ দিতে তৎপর হয়ে উঠেছে কেউ কেউ। রোগীর পরিবারের হাতে চলে আসছে বিশেষ ফোন নম্বর। সেখানে যোগাযোগ করলে বিরাট অঙ্কের টাকার বিনিময়ে কিনে নিতে হচ্ছে ওষুধ।পুলিশের দাবি, রেমডেসিভির কালোবাজারির নেপথ্যে কাজ করছে একটি প্রতারণা চক্র। অভিযোগ, এই চক্র বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে রোগীর পরিজনদের ফাঁদে ফেলে রেমডেসিভির বিক্রি করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। সম্প্রতি রেমডেসিভিরের নামে রাজ্যে বাংলাদেশের ওষুধ বিক্রি করার একটি চক্রও সামনে আসে। অভিযোগ, সাড়ে ৪ হাজারের ওষুধ বিক্রি হচ্ছে ১৮ হাজার টাকায়।
রাজভবনে তৃতীয়বার শপথ নিয়েই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, তাঁর প্রথম কাজ হবে করোনা প্রতিরোধ করা। তার জন্য যা যা করা দরকার তিনি করবেন। রাজ্য সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বেশ কিছু পদক্ষেপ করেছে। সাধারণ মানুষ সরাসরি যাতে অভিযোগ জানাতে পারেন, তার জন্য পুলিশের তরফে হেল্পলাইন নম্বর দেওয়া হয়েছে। হেল্পলাইন নম্বরটি হল ৯৮৭৪৯০৯৬৪০। দেওয়া হয়েছে একটি মেল আইডিও— jointcpcrime@kolkatapolice.job.in।  দ্রুত অক্সিজেন গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য দু’টি হেল্পলাইন নম্বর দেওয়া হয়েছে— ০৩৩২২৫০৫০৯৬, ০৩৩২২১৪৩৬৪৪।
অতিমারিতে জালিয়াতি ও কালোবাজারি রুখতে সরকার ও প্রশাসনকে আরও কঠোর এবং তৎপর হতে হবে। ফেসবুকে সক্রিয়তার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। এই দুঃসময়ে অন্ধকার জগতের দুষ্টচক্রের বিষদাঁত সমূলে উৎপাটন করা ভীষণ জরুরি।