ভারী ভারী কথা নয়, দুলকি চালে পাঠপথে চলতে চেয়ে এই আষাঢ়ে স্মরণ করছি সামসময়িক দুই ভুলে যাওয়া রসস্রষ্টাকে- বিষয়, একই নামের খানিক ভিন্নগতির দু’জনের দু’টি গল্প (নাম- একটি আষাঢ়ে গল্প)। তার আগে দু’জনের সম্পর্কে টুকুন সূচনাকথা অনিবার্য বলেই মনে হয়। কেননা আমরা এই দ্রুতগতিতে অগ্রসরমাণ পাঠককুল নিয়ত উন্নাসিকতায় অগ্রাহ্য করে চলি পেছনের পথটিকে। তাই পাতা উলটে দেখা বা পেছনপানে এগিয়ে যাওয়া অক্ষীণঢঙে জরুরি বলেই মনে করি। এ কোনও হঠোক্তি নয়, পূর্বসূরিদের স্মৃতিধার্য করে রাখা উত্তরদায়, নইলে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি বিপন্ন হতে বাধ্য। আর এই লজ্জারুণ দায় থেকেই আমার এই প্রয়াস যা নিয়ত জারি রাখতে চেষ্টা করি।
প্রথমেই বলি কবি, গল্পকার, উপন্যাসকার তদুপরি রঙ্গব্যঙ্গের জাদুকর কুমারেশ ঘোষ (২১.০১.১৯১৩—৩০.৪.১৯৯৫) সম্পর্কে যাঁর নামের সঙ্গে ‘যষ্টিমধু’ অঙ্গাঙ্গী জড়িত। যশোরের মথুরাপুরে জন্মেছিলেন তিনি। ১৯৩৬ সালে কলিকাতা (তৎকালিক বানান) বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন। উপর্যুক্ত রসসাহিত্য -পত্রিকাটি একক সম্পাদনায় তেতাল্লিশ বছর চালিয়েছিলেন। এই মধুময় পত্রিকাটি যাঁরা পড়েছেন তাঁরা বিলক্ষণ জানেন এর নানাবর্ণিল আলোক-বিচ্ছুরণ। এ ছাড়াও তিনি ‘ত্রিপর্ণা’, ‘উত্তর ভারতী’, ‘সম্মার্জনী’ পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন। একাধিক ছদ্মনামে লিখেছেন তিনি যেমন, কুশ, এডি, কুমারস্বামী, শ্রীচোখাচোখ, অষ্ট-চক্র। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাদি হল- নীল ঢেউ সাদা ফেনা, বিনোদিনী বোর্ডিং হাউস, অবনী সরকারের বউ এবং, স্বামী পালন পদ্ধতি, এক বর অনেক কনে, যদি গদি পাই, হরেকরকম্বা, সরস রুশ গল্প, সবুজ রাশিয়ায় ইত্যাদি। ‘সেই আমি’ নামে একটি আত্মজীবনীও লিখেছিলেন তিনি। সংস্কৃত থেকে বাংলায় মনুসংহিতার তরজমা করেন। রাশিয়া, জাপান-সহ ইওরোপের নানা দেশ ভ্রমণ করেছিলেন এই ভ্রামণিক। ‘সরস রুশ গল্প’ বইটির জন্য ১৯৮৫ সালে তিনি সোভিয়েত ল্যান্ড নেহরু পুরস্কার পান ও ১৯৯০ সালে শিশু সাহিত্যে ভারতীয় জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন ‘হরেকরকম্বা’ বইটির জন্য। ১৯৯৫ সালে সুকুমার গদ্য ও নির্মল হাস্যরসের এই সৃজক প্রয়াত হন।
অজিত কৃষ্ণ বসু বা অ কৃ ব’র (০৩.৭.১৯১২—০৭.৫.১৯৯৩) কথা উঠলেই অনুবাদক মানুষটির কথা মাথায় আসে। কিন্তু তাঁর বিচিত্র-চর্চিত ক্ষেত্রের সামূহিক খবর আমরা খুব একটা রাখি না। তিনি শুধু রসসাহিত্যই সৃষ্টি করেননি, জাদুবিদ্যা, সঙ্গীতক্ষেত্রেও তাঁর সাগ্রহ পারঙ্গমতা উল্লেখ্য। তাঁর জন্ম ঢাকায়, পড়াশোনা সেখানকার জগন্নাথ কলেজে ও কলকাতার স্কটিশচার্চ কলেজে। ১৯২৬ সালে মাত্র চোদ্দো বছর বয়সে ‘খোকাখুকু’ মাসিকপত্রে প্রকাশিত অনুবাদ কবিতা দিয়েই তাঁর লিখনযাত্রা শুরু। কৌতুকরসের কবিতা, গল্প, উপন্যাস তাঁর বিচরণ-ক্ষেত্র। তৎকালিক বম্বের ‘শঙ্করস উইকলি’ তেও তিনি ইংরেজি কৌতুক কবিতা লিখেছেন। শনিবারের চিঠিতে ধারাবাহিক ও পরে গ্রন্থবদ্ধ (১৯৫৩) ‘পাগলা গারদের কবিতা’ তাঁর অন্যতম সেরা রচনা। এ ছাড়া তাঁর গল্প উপন্যাস মিলিয়ে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাদি হল: এক নদী বহু তরঙ্গ, চন্দনপুরের কাহিনি (১৯৬৬), অ কৃ ব’র বিচিত্র গল্প সংকলন (১৯৭৬), বিধাতা (১৯৬৩), ম্যারিনা ক্যান্টিন, সৈকত সুন্দরী ও বহু পুরুষ (১৯৬৭), প্রজ্ঞা পারমিতা, নন্দিনী সোম (১৯৬৬), শেষ বসন্ত, শকুন্তলা স্যানাটোরিয়াম (১৯৬৩)। তিনি মার্ক টোয়েন ও ন্যাথানিয়েল হথর্নের বইও তরজমা করেছেন। প্রথমদিকে বিখ্যাত ডি জে কিমার বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ করলেও পরে গোবরডাঙ্গা ও আশুতোষ কলেজে ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষকতা করেন। জাদুসম্রাট পি সি সরকার ছিলেন তাঁর বাল্যবন্ধু। সেই সাহচর্যের ফলে তিনি ১৯৬৪ সালে ‘যাদুসাহিত্য’ শিরোনামে যে বইটি লেখেন তা দিল্লির নরসিংহ দাশ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিল। তিনি নিবিড় সঙ্গীতচর্চা করেছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র দে (কানা কেষ্ট), ওস্তাদ গুল মহম্মদ খাঁ ও তারাপদ চক্রবর্তীর সুমহান ছত্রচ্ছায়ায়। এই নানাগুণে গুণান্বিত মানুষটি ১৯৯৩ সালে প্রয়াত হন।
আমাদের বালকবেলায় ঝিপঝিপে অলস বর্ষাদিনে ঘরের দাওয়ায় বসে কোনও এক গল্পোয়াড়ের (যেমন লেখোয়াড়) মাথামুণ্ডহীন গল্প গিলতাম হাঁ করে। তা ছিল প্রকৃত অর্থেই আষাঢ়ে গল্প অর্থাৎ বিশুদ্ধ গাঁজাখুরি আখ্যান। সে সব যে মন থেকে সব মেনে নিতাম, তা নয়; কিন্তু যুক্তিজালে ফাঁসিয়ে তার নিঃসার প্রাগলভ্যরূপ মজা মাঠে মারা যাক, এটা কেউই চাইতাম না। আজকাল আর এমন কথক দেখা যায় না খুব একটা। দুরন্ত সময়ের চাপ-প্রাবল্যে তাঁরা সব অন্তর্হিত। যাই হোক, এমনই একটি গল্প লিখেছিলেন কুমারেশ ঘোষ, ‘একটি আষাঢ়ে গল্প’ নাম দিয়ে। যথার্থ আষাঢ়ে, আজগুবি বলতে যা বোঝায়, এ গল্প তাই। গল্পের নামহীন কথক কদিনের ছুটিতে দেওঘর গেছে, দ্বিবিধ উদ্দেশ্যে- হাওয়াবদল আর তীর্থদর্শন। উঠেছে দূর সম্পর্কের খুড়ো কাশীশ্বরের বাড়ি ‘অধমের ধাম’এ। এই কাশীখুড়োই গুল্পের (গুল-গল্প) আঁতুড়ঘর। তিনি ‘বড্ড বেশী বকেন এবং বাজে বকেন’। ভাইপোকে দেখে প্রথমেই বললেন, ‘ইউ আর টু-উ লেট, টু-উ লেট… পশ্চিমের হাওয়া খেতে আর পঁচিশটা বছর আগে আসতে পারলি নে?’ যদিও ভাইপোর জন্মই হয়নি তখন তবুও এ কথা শোনানোর অর্থ দেওঘরের হাওয়া ‘ইন্ডাস্ট্রি’র ফাঁদে পড়ে বিষিয়ে গেছে আর ‘ড্যাঞ্চি’ বাবুরা এসে জিনিসপত্রের দাম এতটাই উঁচুতে তুলে দিয়েছে যে খেয়েদেয়েও আরাম নেই। আর ‘টু-উ লেট’ নিয়ে তার যে গুল্প সে কথায় পরে আসব।
যাই হোক, কদিন হাবিজাবি কথার সঙ্গে বিনা পয়সার খাবার গিলে রয়েসয়ে ছিল ভাইপো। ফেরত আসার আগের দিন মুরগির মাংসের সঙ্গে ভাত খেতে খেতে যে মোক্ষম গুল্পের কবলে পড়েছিল কথক ভাইপো তাতে তার ঘনঘন বিষম গিলে প্রাণ ওষ্ঠাগতপ্রায়। কাশীখুড়ো অসুস্থ দিদিমাকে দেখতে যাওয়ার অনেকদিন আগের কথা দিয়ে শুরু করল। মুমূর্ষু দিদিমাকে দেখতে ট্রেনে করে কলকাতা যাওয়ার জন্য অপেক্ষার ঝুঁকি না নিয়ে সাইকেল নিয়ে বাঁইবাঁই ছুটিয়ে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই দেওঘর থেকে কলকাতা পৌঁছে গেল। ভাইপো বুঝল ‘গাঁজায় দম দেওয়া হচ্ছে’ আর খুড়ো বুঝিয়ে দিল, পশ্চিমের হাওয়া-পুষ্ট শরীরে সে দিব্য চলে গেছে। গিয়ে দেখে ‘দিদিমাকে গ্যাস দেওয়া হচ্চে’। বিচ্ছু ভাইপো ‘কী গ্যাস’ জানতে চাইলে খুড়ো অম্লান বলে, ‘যে গ্যাসে রান্না হয়, রাস্তার আলো জ্বলে।’ ঘরভর্তি বিষণ্ণ লোকজনের সামনে ডাক্তার যখন বলেন ‘Too late’ এবং আরও বলেন ‘এ সব রোগীকে পশ্চিমে নিয়ে গিয়ে হাওয়াবদল করাতে পারলে…’; কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গেছে। এ কথা শুনে খুড়ো ছুটে বাইরে গিয়ে ধুলোমাখা সাইকেলটা টেনে হিঁচড়ে রোগীর ঘরে নিয়ে এল। তারপর রবারের নল লাগানো ডুস থেকে নলটা খুলে সাইকেলের চাকার ভালভের সঙ্গে জুড়ে দিল। তারপর ডুসের নজলটা দিদিমার নাকের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। এ কথা শুনে ভাইপোর ‘ভাতের গরাসও বুঝি নাকে ঢুকে যাবার জোগাড়!’ এই অভিনব ব্যবস্থায় দুটো চাকার হাওয়া গিলে দিদিমা চাঙ্গা হয়ে উঠে বসল। নাতির সঙ্গে কুশল বিনিময়ের পর হঠাৎ দিদিমা বলে ওঠে, ‘হ্যাঁরে আমার নাকে কী একটা দুর্গন্ধ আসচে যেন।’ আসলে তাড়াহুড়োয় নলের মুখটা ধুয়ে নেওয়া হয়নি। তাই এই বিপত্তি।
যাই হোক, এই গুল্প শুনে ভাইপো আমতা আমতা করে জানতে চাইল, ‘সাইকেলের চাকার হাওয়ায় আপনার দিদিমা চাঙ্গা হয়ে উঠলেন কী করে?’ উত্তরে গম্ভীরমুখে খুড়ো মোক্ষমতমটি ছাড়ল: আরে বোকা, ঐ চাকা দুটোতেই তো এই দেওঘরের পশ্চিমের হাওয়া ভরা ছিল।’ ভাইপো চরম বিষম খেলেও পাঠক এক মজারু ফোয়ারায় ভাসতে থাকল।
নামকরণ এক হলেও অ কৃ ব’র গল্পটি ঠিক আজগুবি পর্যায়ে ফেলা যাবে না; বরং এই গল্প যেন বিরহী যক্ষের মতো অপেক্ষার আখ্যান যদিও তা খিন্নতায় আচ্ছন্ন না হয়ে মজা-রসে টইটম্বুর। এক পয়লা আষাঢ়ে পাড়ার ভবঘুরে বেকার ভবনিধি ভঞ্জকে গল্পকথক অর্থাৎ বড় অফিসের ছোটো কেরানি পনেরো টাকা ধার দিয়েছিল। পঁচিশ বছর পেরিয়ে গেলেও সে টাকা উদ্ধার বা শোধ হয়নি, নানান যৌক্তিক- অযৌক্তিক অছিলায়। মজার ব্যাপার হল, এ টাকাও অন্যের কাছ থেকে ধার নিয়ে কথক দিয়েছিল পাছে পাড়াতুতো ভাইকে অন্য কেউ দিয়ে ফেলে, সেই ভয়ে। এরপর থেকে ভবনিধি ভুলে যেতেই থাকে আর উপার্জনহীন ছেলেটাকে কাজ জুটিয়ে টাকাটা ফিরে পেতে দায়বদ্ধ দাদা নিয়মিত কর্মখালির বিজ্ঞাপন দেখে দরখাস্ত ছাড়তে পরামর্শ দেয়। আবার রোজ খবরকাগজ জোটানোর অসুবিধার কারণে সে ভবনিধিকে নিজের টাকায় এক পাঠাগারের সভ্য করে দেয়। উপরন্তু কাগজ, খাম কেনার জন্য ‘ভবনিধি একটা টাকাও চেয়ে’ নেয়। কিন্তু নচ্ছার ভবনিধি চাকরি খোঁজার বদলে লাইব্রেরি থেকে খান পঞ্চাশ উপন্যাস পড়ে নিজেকে ঋদ্ধ করার কথা বলে। এখন গরজ বড় বালাই। এরপর থেকে সাত জম্মের দাদা ভবনিধির উপর ভরসা না করে নিজেই ওর হয়ে এমনকি ওর সইটাও করে দিয়ে দরখাস্ত ছাড়তে থাকে। এতে অফিসের বড়বাবু ভুল বোঝেন এবং সেই ভুল ভাঙাতে বিষয়টা সে খোলসা করে এবং মুখ ফসকে বলে ফেলে যে ভবনিধি ওর শ্যালক। আর ভবনিধির সম্পর্কে ভালো ভালো কথাবার্তা জেনে বড়বাবু ভিন্ন ভাবনায় উৎসাহিত হন আর দাদা ভাবে এইবার ভব’র একটা হিল্লে হবে আর তার টাকাটাও সে ফেরত পাবে।
তারপর যা হওয়ার হল। শালা- অতথ্য তেমন গুরুত্ব পেল না। ভবনিধি ওই অফিসেই জাঁকিয়ে চাকরি করতে লাগল, উপরি আয়ও হতে লাগল তার’ কিন্তু পঁচিশ বছর আগেকার ঋণ’ অশোধিতই রয়ে গেল। শেষে যখন গল্পকার বিরসবদনী কথকের মুখ দিয়ে বলাচ্ছেন ‘আগামী কাল পয়লা আষাঢ় তারই রজত-জয়ন্তী’ তখন পাঠক দুঃখী না হয়ে এক অমলিন কৌতুকরসে জারিত হচ্ছেন।
( আজকের পাঠক নানাবিধ জর্জরিত অবস্থার মাঝে এই গল্পাবলি পড়ে খানিক খোলা হাওয়ায় মন্দ্রিত হোক, এই আশা নিয়েই এই সান্দ্র প্রয়াস।)