সারথি বিশ্বাস

দীর্ঘদিন ‘পাঠশালা’হীন আমাদের পড়ুয়ারা। আর এ বছর তো শিক্ষায় সার্বিক পরীক্ষাহীনতার বছর। শুধু রোগের অতিমারিই নয়, নেই-শিক্ষার অতিমারিও গ্রাস করেছে আমাদের। ভোটযজ্ঞ থেকে নামযজ্ঞ, মানুষের কোনও অধিকারই বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে না, শিক্ষার ক্ষেত্রেই কেবল অশ্বমেধের ঘোড়াটিকে আটকে রাখা হয়েছে খুঁটিতে।
এই অবস্থায় প্রকাশ পেল মাধ্যমিকের ফল। হ্যাঁ, শুধুই ফল। পরীক্ষা তো হয়নি, তাই ইচ্ছে করেই মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল বললাম না। এই ফলাফল নিয়ে পড়ুয়াদের কার কেমন প্রত্যাশা ছিল জানি না, তবে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের প্রত্যাশাটা প্রকট হচ্ছিল অনেকদিন ধরেই। এবং সেই মতোই সরগরম হয়ে উঠলো নেটপাড়া। দিনভর পড়ুয়াদের রেজাল্ট নিয়ে রঙ্গ-তামাশা চলছে। ১০০ শতাংশ পাশের হার! ৭৯ জন একই নম্বর পেয়ে প্রথম! সবই বেশ হাসির খোরাক জুগিয়েছে নেট-নাগরিকদের। দু’দিন পরে উচ্চ মাধ্যমিকের ফল নিয়েও একই এপিসোডের রিপিট টেলিকাস্ট হবে, ধরে নিতেই হচ্ছে।
হাসি শরীর ও মনের স্বাস্থ্যের জন্য খুব উপকারী এবং জরুরি। অতএব হাসুন, প্রাণ খুলে হাসুন। তবে দেখেশুনে, কাউকে আঘাত দিয়ে নয়। খেয়াল রাখুন আপনার হাসিতে দূষণ না ছড়ায় যেন, কারও যেন শ্বাস নিতে কষ্ট না হয় তাতে। নির্মল হাসি উপহার দিন। হাসাহাসি করার জন্য অনেক বিষয় পাবেন, দয়া করে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক রেজাল্টটাকে ছেড়ে দিন। পড়ুয়ারা পরীক্ষা দিতে চায়নি এমন তো নয়। আবার পরীক্ষা না হওয়ায় প্রতিটা পড়ুয়াই খুব খুশি এমনও নয়।
মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক দুটোই স্কুল পর্যায়ের পরীক্ষা হলেও আমরা এ-দুটোকে নিয়ে এত মাতামাতি করি, ফল প্রকাশের পরে সাংবাদিকেরা যে ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েন প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়ের বাড়িতে, রাতারাতি সেলিব্রিটি হয়ে যায় তারা। ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে মিষ্টিমুখ, ফুল, শুভেচ্ছা, ফটোশুট, টিভিতে সাক্ষাৎকার! পড়ার টাইম, খাওয়ার টেবিল নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ! সমাজের সর্বস্তরের এই বাড়তি মনোযোগ পড়ুয়াদের মনে বাড়তি প্রত্যাশার জন্ম দেয়। আমাদের দেশে আর কোনও পরীক্ষার ফল নিয়ে সমপর্যায়ের এমন সার্বিক মাতামাতি হয় না। অনেকটা সেইজন্যও পরীক্ষা না-হওয়ার হতাশা অধিকাংশ পরীক্ষার্থীকে গ্রাস করেছে। আমরা আত্মহত্যার ঘটনাও দেখেছি। কিন্তু আমরা বোধহয় তেমনভাবে তাদের সমানুভূতি দেখাতে পারিনি। প্রথম থেকেই আমরা তাদের লজ্জিত করেছি, অপরাধী বানিয়েছি। ঠিক যেমন কোভিড আক্রান্তকে এতদিন করেছি।
হ্যাঁ, এরাও অতিমারির শিকার। দায়ি এরা তো নয়! অতিমারির বাইরে আর যদি কিছু থেকে থাকে সে আমাদের ব্যর্থতা। আমরা পারিনি তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে। কাজেই, কোনও রকম ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ওদের প্রাপ্য নয়। একজন পড়ুয়াও অসৎ উপায় অবলম্বন করে এ বারের রেজাল্ট আনেনি, এটুকু অন্তত বলাই যায়। এই রেজাল্টে তাদের ডান, বাম কোনও হাতই নেই। সুতরাং, আপনিও আপনার অজুহাতটি গুটিয়ে রাখুন।
নিদেনপক্ষে, শিক্ষক-শিক্ষিকারা হাসাহাসির টিমে যোগ দেওয়ার আগে একবার ভাববেন, এরা কিন্তু সবাই আমাদের ছাত্রছাত্রী। আমাদের দায়িত্ব অনেকখানি, আমরা অন্তত পারি না নিরাপরাধ মনগুলোতে ব্যথা দিতে। সোশ্যাল মিডিয়ায় শিক্ষিত সচেতন নাগরিকদের রঙ্গ, তামাশা দেখে মনে হচ্ছে কোভিডের পাশাপাশি নেই-শিক্ষার অতিমারি কী ভাবে আছন্ন করে আছে আমাদের। পরিশেষে সবার জন্য একটি কথা, আমরা অধিকাংশই তো সুযোগের অভাবে সৎ, তাই না?

(ফিচার ছবি গুগল থেকে নেওয়া। মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)