দেবযানী ভৌমিক চক্রবর্তী

এ ভাবে আর কতদিন? সবার মনে একটাই প্রশ্ন৷ এক অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে মানব সভ্যতার টিকে থাকার লড়াই৷ করোনার চোখ রাঙানিতে আক্রান্ত হচ্ছে মানবজীবন, বিপন্ন হচ্ছে সভ্যতা৷ সমাজবদ্ধ জীব মানুষ আজ বাধ্য হয়েই সামাজিক দূরত্ব মেনে চলছেন৷ দস্তানা সকলে না পরলেও মাস্ক পরাটা কিন্তু প্রায় সকলেই আয়ত্ত করে নিয়েছেন৷ এ রোগে নিজেকে সুরক্ষিত রাখার সঙ্গে অন্যের সুরক্ষাও জড়িত— এই বোধটাও সার্বিক ভাবে জাগিয়ে তুলেছে করোনা-ভীতি৷
আর এই ভীতি থেকেই সমাজের মধ্যে থেকেও আজ মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে বাস করছে৷ আর এই বিচ্ছিন্নতা থেকেই গ্রাস করছে হতাশা৷ গৃহবন্দিতে অনভ্যস্ত জীবনে তারা হাঁপিয়ে উঠছে৷ বাধ্য হয়েই স্বেচ্ছা নির্বাসিত জীবনটাকে মেনে নিলেও মনের ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলছে এহেন জীবনযাপন৷ পরিবারের নির্দিষ্ট চৌহদ্দির মধ্যে প্রতি মুহূর্তে একই মানুষের সংস্পর্শ মানুষকে ক্লান্ত করে তুলছে মানসিক ভাবে৷ পরস্পরের ভুল-ত্রুটিগুলো বেশি বেশি করে দৃষ্টিগোচর হচ্ছে, ফলে গার্হস্থ্য হিংসাও বেড়ে যাচ্ছে৷ চার দেওয়ালের বাইরে যে বৃহত্তর দুনিয়া, তা মানুষকে মানসিক ব্যাপ্তি দেয়, দেয় প্রশান্তি৷ এ ছাড়াও প্রতিদিনের ব্যস্ততম জীবনে মানুষ দুশ্চিন্তা বা অহেতুক উদ্বেগের শিকার কম হয়৷ কিন্তু এই গৃহবন্দি জীবন মানুষকে দিয়েছে অনন্ত অবসর৷ ফলে মস্তিষ্কের অলসতা থেকেই জন্ম নিচ্ছে উদ্বেগ-আশঙ্কা। পরিণাম— অবসাদ, হতাশা৷
শিল্পী, সাহিত্যিকদের অনেকেই বলছেন, সৃষ্টি তো করে মন, সেই মনটাই যখন এত বিষাদময়, তখন নতুন ভাবনা আসবে কী করে! তাই বলে কি সৃষ্টি থেমে যাবে! বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষকরা সাহিত্যের যে যুগবিভাগ পড়ান, সেখানে তো আমরা দেখি প্রতিটি যুগ শেষ হচ্ছে একটা সঙ্কটময় মুহূর্তে, কোনও এক প্রতিস্পর্ধী শক্তির আক্রমণে৷ তা হলে এ বার কি সেই শক্তি করোনা? যা কবি-সাহিত্যিকদের আপাতভাবে সৃজনশীলতা থেকে দূরবর্তী করে দিচ্ছে! এরপর কি তবে করোনা-পরবর্তী সাহিত্যযুগ আসছে! ভাবনাগত দিক থেকে কিছু পরিবর্তন আসা তো স্বাভাবিক৷ কারণ, সাহিত্য তো যুগের দাবিকে অস্বীকার করতে পারে না৷
হতাশা গ্রাস করছে পড়ুয়াদেরও৷ তারা ক্লাস করছে অনলাইনে৷ প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ ভিন্ন এই পাঠদান পদ্ধতিতে অনেক পড়ুয়াই সঠিক অর্থে মনোনিবেশ করছে না বা করতে পারছে না, আবার শিক্ষকদের পক্ষেও সবাইকে বিশেষ ভাবে নজর করা প্রায় অসম্ভব৷ ফলে আই-কন্ট্যাক্ট ছাড়া এই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে পারস্পরিক বোঝাপড়াটা সে ভাবে গড়ে উঠছে না৷ এ ছাড়া অনলাইন পরীক্ষা পদ্ধতিতে যেহেতু কেউ নজরদারি করার জন্য থাকে না, তাই ছাত্রদের মধ্যে পাঠ্যবিষয় আয়ত্তে আনার তাগিদটাও সে ভাবে নেই৷ করোনা পরিস্থিতির সঙ্গে সমঝোতা করতেই এহেন ব্যবস্থা, আর কোনও বিকল্প পথ নেই৷ কিন্তু একটা প্রজন্ম অসহায় ভাবেই সময়ের কাছে পিছিয়ে পড়ছে৷ হতাশা গ্রাস করছে তাদেরও৷ জীবন থেকে স্বাভাবিক ছন্দ হারিয়ে যাচ্ছে এই পড়ুয়াদের৷
শপিং মল, সিনেমা হল, বিউটি পার্লার, হোটেলে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের কাছে বড় আতঙ্কের বিষয় ‘লকডাউন’৷ স্বল্প বেতনে কাজ করলেও, মাস গেলে সেই টাকাটা তো নির্দিষ্ট, কিন্তু সেটাও যদি বন্ধ হয়ে যায়! কী ভাবে চলবে তাঁদের! ‘‘লকডাউনে মালিকই বা আর কতদিন বসিয়ে রেখে মাইনে দেবে, বলুন তো? এ বার সপরিবার পথে বসতে হবে’’, বলছিলেন এক হোটেলের অর্ডার বুকিং সেন্টারের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক যুবক৷
ট্রেন অনেকেরই রুজি রোজগারের উপায়৷ সেই ট্রেন যখন বন্ধ হয়, বেকার হয়ে পড়েন অসংখ্য ফেরিওয়ালা৷ আবার ট্রেনপথে আসা যাত্রীদের নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দেন যে রিকশা, অটো বা টোটোচালক তাঁরাও ট্রেন না চললে বিপদে পড়েন৷ সেখানেও হতাশা৷ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে চলেছেন, কুর্নিশ তাদের৷ কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে কারও পক্ষেই আহার জোগানো সম্ভব নয়৷ এটাই বাস্তব৷
করোনাকালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য প্রায় সব সরকারি বা আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান খোলা রয়েছে৷ সেই সকল চাকুরেদের মধ্যেও সবসময়ই একটা মানসিক অস্থিরতা বা দুশ্চিন্তা রয়েছে, ‘এই বুঝি আক্রান্ত হলাম!’ বিশেষ করে ব্যাঙ্ককর্মীদের তো সরাসরি জনসংযোগে আসতে হয়৷ স্বাস্থ্য-পরিষেবায় যুক্ত যাঁরা, দিনরাত এক করে খাটছেন তাঁরাও৷ সরাসরি রোগ ও রোগীর সংস্পর্শে আসায় তাঁদের অনেকেই আক্রান্ত হয়েছেন, ঘটেছে জীবনহানির মতো ঘটনাও৷ পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি চিন্তিত তাঁরাই৷
মানসিক হতাশা এমন স্তরে পৌঁছচ্ছে যে মানুষের মধ্যে সহনশীলতা একেবারে হ্রাস পাচ্ছে৷ তাঁরা অহেতুক একে অপরকে আক্রমণ করছেন৷ ফ্রয়েডের অনুসরণে আমরা বলতে পারি, মানুষের সুপার ইগো আজ ইগোর চেয়ে বেশি শক্তিশালী হয়ে পড়ছে, যার ফল এমন মনের অসুখ বা হতাশা৷ মানব-সভ্যতার জন্য এটা বেশ চিন্তার বিষয়৷ তবুও বলি, আশাবাদ ধ্বনিত হোক৷ সভ্যতা বাঁচুক৷

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত। ফিচার ছবি গুগল থেকে নেওয়া)