সুদীপ জোয়ারদার

সে সব রাত ছিল জ্যোৎস্নার। মায়াময়, স্নেহময় জ্যোৎস্নার। এমন জ্যোৎস্না যে পৃথিবীর শিশুদের ঘরে আটকে রাখাই দায়। তবে ছোটদের পৃথিবীটা তখন বড়ই ছোট। উত্তরে এক ভয় ধরানো নিমগাছ, দক্ষিণে এক বন্ধুবট আর পুবে, পশ্চিমে বোসবাড়ি আর আমাদের বাড়ির পিছনের গাম্ভিল গাছটা। পৃথিবীর চৌহদ্দি এটুকুই। কিন্তু এর মধ্যেই ছোটদের ওই চাঁদের আলোয় মধুর কলতান, লাফালাফি, ছোটাছুটি। আবার কখনও চাঁদের দিকে চেয়ে গেয়ে ওঠা, ‘এমন চাঁদের আলো/মরি যদি…’।
ওদিকে এমন চাঁদনি রাতে কোজাগরী লক্ষ্মী বসেছেন আসনে। ‘দোলপূর্ণিমা নিশি নির্মল আকাশ/ মন্দ মন্দ বহিতেছে মলয় বাতাস/ লক্ষ্মীদেবী বামে করি বসি নারায়ণ/কহিতেছে নানা কথা, সুখে আলাপন।’ দেবীর পাঁচালী পড়া হচ্ছে ঘরে ঘরে। শঙ্খের আওয়াজ আসছে সরকার বাড়ি, ব্যানার্জি বাড়ি, বোস এবং আরও নানা বাড়ি থেকে। জ্যোৎস্নাময় সন্ধ্যাটা ওদের পৃথিবীজুড়ে পুজোময়। এমন কল্যাণী-রাতে মরার কথা কি মানায়! কিন্তু কী করা যাবে? চাঁদ নিয়ে তখন ওই একটা গানই যে বুকে শিস দিয়ে চলেছে!
গ্রামের রাস্তা ধরে পুরোহিত চলেছেন। যতই জ্যোৎস্না হোক, পথের ধারে গাছগাছালি তো কম নেই। ঝোপঝাড়ের পাশে এলেই জ্বলে উঠছে তাঁর দু’ব্যাটারির টর্চখানা। রেলের পরিত্যক্ত ঘরখানা পেরোতেই তাঁকে নিয়ে হুড়োহুড়ি। এ বলে ‘আগে আমাদের বাড়ি’ তো ও বলে ‘আগে আমাদের’ আবার কেউ গলা উঁচিয়ে বলে, ‘কথা কিন্তু ছিল, সবার আগে আমাদের বাড়ি বসবেন।’

দে বাড়ির প্রসাদ খেয়ে ছোটরা আবার ছোটে ব্যানার্জি বাড়ি। ‘আয় আয় সবাই আয়’ বলে ছোটদের ডেকে নেন সে বাড়ির স্নেহময়ী মেজদি। এখানে ভোগ বেশি, প্রসাদ কম। মিষ্টি জিনিস দু’বাড়িতে খেয়ে খেয়ে মনও এখন ভোগমুখী। কলাপাতা চেটেপুটে খায় সবাই। এখনও কয়েক বাড়ি বাকি। কিন্তু পেটে আর বেশি কিছু ধরবে কি? আর এক বাড়ির পর থেকেই দল ছোট হতে থাকে।

পুরোহিত মশায় ধন্দে পরেন। পরে ঠিক হয়, একেবারে পিছনের ব্যানার্জি বাড়ি থেকে সারতে সারতে সামনে আসবেন। এরই মধ্যে শোনা যায়, সরকার বাড়ির পুজো শেষ। ওদের অবশ্য অন্য পুরোহিত। ছোটরা ছোটে জ্যোৎস্না ভেদ করে। গিয়ে দেখে লম্বা লম্বা সতরঞ্চি তিন ভাঁজ করে বিছানো হয়েছে আসন। বসেও পড়েছে সমবয়সী কয়েকজন। দুপুরের পর রাতের খাওয়ার আগে পর্যন্ত তখন কেই বা কিছু খেত! আজ মা দিদিদের ভোগের আয়োজন, আর নাড়ুর ভিয়েন পাকাতেই দিন কাবার। অত তরিবত করে খাওয়া হয়নি দুপুরের আহারও।
খিদে-পেটে প্রসাদের সব কিছুই যেন অমৃত। তবু প্রসাদে পেয়ারার কুচি পড়লেই সযত্নে সরিয়ে রাখে শিশু ভোলানাথেরা। ছোটদের মুখ এমনিতেই পিঁপড়ে। শুধু মিষ্টি খোঁজে। আজ রয়েছে হরেক মিষ্টির আয়োজন। নাড়ু, নকুলদানা, পায়েস, আরও কত কী! যতই খিদে থাক, পেয়ারা কি এত মিষ্টি স্বাদের খাবার পেলে আর মুখে ওঠে!
লক্ষ্মী-রাতে পেঁচার দর্শন পাওয়া সৌভাগ্যের। তবু কেউ কেউ তা পেয়েও যায় এক আধবার। কখনও সরকার বাড়ির পেয়ারা গাছে, কখনও বড় পুকুরের ধারের পোড়ো বাড়ির ছাদে। সে বার পেঁচার দেখা পাওয়া গেল ব্যানার্জি বাড়ির কুলগাছে। সৌভাগ্যের প্রতীক, কিন্তু সে বার ব্যানার্জি বাড়িতেই ঘোর অঘটন। ছোট মেয়ে ঠাকুরের সামনেই পড়ে গেল অচৈতন্য হয়ে। পুজো মাথায় উঠল। জল ঢালা, পাখার বাতাস করা শুরু হয়ে গেল তাকে ঘিরে।
একটু পরে চোখ মেলল সে। উপবাস নাকি অন্য কারণ? কে একজন বলল, ‘মৃগী নয় তো!’ এত কিছুর মধ্যে ছোটরা থাকতে রাজি নয়। তারা আবার ছুটল দে বাড়ির দিকে। দে বাড়ি মানে রেলের কোয়ার্টার। ওখানে বাঁধানো উঠোনে, চিলতে বারান্দায় প্রসাদ খাওয়ার জন্য আসন পাতা। আর সর্বত্রই কী সুন্দর আলপনা! দে বাড়িতে রয়েছে সে আমলের এক দুর্লভ জিনিস, রেডিয়ো। ওখানে বাজছে গান, ‘শঙ্খ বাজিয়ে তোমায় ঘরে এনেছি।’
দে বাড়ির প্রসাদ খেয়ে ছোটরা আবার ছোটে ব্যানার্জি বাড়ি। ‘আয় আয় সবাই আয়’ বলে ছোটদের ডেকে নেন সে বাড়ির স্নেহময়ী মেজদি। এখানে ভোগ বেশি, প্রসাদ কম। মিষ্টি জিনিস দু’বাড়িতে খেয়ে খেয়ে মনও এখন ভোগমুখী। কলাপাতা চেটেপুটে খায় সবাই। এখনও কয়েক বাড়ি বাকি। কিন্তু পেটে আর বেশি কিছু ধরবে কি? আর এক বাড়ির পর থেকেই দল ছোট হতে থাকে।
জ্যোস্নাময়, পুজোময়, প্রসাদময় রাতটার আয়ুও কমতে থাকে চুপিসারে। তারপর একসময় সে ডুবে যায় অতল ঘুমের গহ্বরে। মাঝরাতে কারও ঘুম ভেঙে গেলে সে দেখে ফুল, বেলপাতা আর ঘট নিয়ে স্থির চোখে চেয়ে আছেন কমলাসনা।
রাত শেষ হয়। দিন আসে। দিনের পরে দিন। দ্রুত পালটায় দৃশ্যপট। দে বাড়ির কর্তার চাকরি শেষ হতেই কুড়ি বছরের সংসার তুলে কোয়ার্টার খালি করে। শহর থেকে শহরে ছড়িয়ে যায় সরকার বাড়ির সন্তানেরা। সে বাড়ি নিঝুম পড়ে থাকতে থাকতে একদিন অন্য মালিকের হাতে গিয়ে হয়ে যায় কাঠ চেরাইয়ের কল। আর ব্যানার্জি বাড়ির স্নেহময়ী মেজদি একদিন নিরুদ্দেশের পথে পাড়ি দিয়ে পাল্টে ফেলেন উপবাসের তিথি। ওদিকে আমরা না ঘরকা না ঘটকা হয়ে ঝুলে থাকি মাঝখানে। গ্রাম বলে, তুমি শহরের। শহর বলে, তুমি গ্রামের।
কোজাগরী আজও ওখানে আসে পূর্ণাবয়ব চাঁদখানা নিয়ে। কিন্তু চাঁদময় রাতটা আর পুজোময়, প্রসাদময় হয়ে ওঠে না। রাস্তা জুড়ে ইলেকট্রিক আলো দেখে জ্যোৎস্নাও যেন আড়ি দেয় সবার সঙ্গে।

(ফিচার ছবি গুগল থেকে নেওয়া। মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)