প্রসূন আচার্য

অনেকেই বিশ্বাস করেছিলেন তৃণমূলের যুবরাজ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা। তিনি বলেছিলেন, ‘‘এই তৃণমূল নতুন তৃণমূল। পুরভোটে কেউ জোর জুলুম করে ভোট করবে না। যদি দলের কেউ করে, তার বিরুদ্ধে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ টিভি চ্যানেলে বসে তৃণমূলের নেতারাও সেই কথার প্রতিধ্বনি করেছিলেন।
কিন্তু ভোটের দিন যে ছবি টিভিতে দেখা গিয়েছে, তাতে স্পষ্ট অভিষেক তাঁর মতো বলেছিলেন। কিন্তু জয়ের নেশায় উন্মত্ত তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশ তাঁর কথায় কান দেয়নি। অথবা, শাসকের চরিত্রই তৃণমূল নেতারা পালন করেছেন। পুলিশ ও রাজ্য নির্বাচন কমিশন ছিল নীরব দর্শক।
ফলে পুরভোটে সন্ত্রাস থেকে বুথ দখল সবই হয়েছে। সেই ছবি যাতে সিসি ক্যামেরায় ধরা না পড়ে তার জন্য আগের দিনই ক্যামেরার লেন্সে কাগজ সাঁটার ছবি আমরা দেখতে পেয়েছি। তৃণমূলের জন্মদাত্রী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য মনে করেন, ভোট ভালো হয়েছে। বিরোধী দলের অভিযোগ মিথ্যে।

বিরোধীদের জায়গা না ছাড়লে শুধু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মৃত্যু হয় তাই নয়, শাসকের উপরেও মানুষের আস্থা চলে যায়। রাজ্যকে কি একেবারেই বিরোধীশূন্য করে দিতে চায় তৃণমূল? এর উত্তর কিন্তু অভিষেককেই খুঁজতে হবে।

শুধু বিরোধী দলের কর্মীরাই নন, জনা দশেক বিরোধী দলের প্রার্থী মার খেয়েছেন। দিনের শেষে চার জন বিরোধী দলের প্রার্থীকে মার খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। সবচেয়ে বেশি গন্ডগোল হয়েছে কংগ্রেস, বিজেপি বা সিপিএম যে সব আসনে গত বার জিতেছিল, সেই সব জায়গায় এবং কিছু মুসলিমপ্রধান এলাকায়। যেখানে এখনও সিপিএম বা কংগ্রেসের কিছু সংগঠন শক্তি আছে।
বিজেপি-তৃণমূলের পুর বোর্ডের ডেপুটি মেয়র, ২৫ বছরের বেশি বড় বাজারের বিজেপি কাউন্সিলর মিনাদেবী পুরোহিতের পোশাক ছিঁড়ে দেওয়া হয়েছে। বামেদের আমলে মেয়র পরিষদ ফইজ খানকে বেধড়ক মেরে তাঁর গাড়ি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। কারণ, অভিষেক যাই বলুন, তৃণমূলের ১৪৪ জন প্রার্থীই জিততে চান। সবাই জানেন, এখন রাজ্যে সব থেকে বড় ব্যবসা হচ্ছে প্রমোটিং বা রিয়েল স্টেট। কাউন্সিলর হলে তবেই সেখান থেকে টাকা রোজগার সম্ভব। তার উপরে আছে পুরসভার টেন্ডারের কাজ।
গত বিধানসভার ভোটের হিসেবে ১৪৪টি আসনে তৃণমূল পেয়েছিল ৫৮ শতাংশ। এগিয়ে ছিল ১৩৩ টি আসনে। বিজেপি পেয়েছিল ২৭.৫৫ শতাংশ ভোট। এগিয়েছিল ১০টি আসনে। আর কংগ্রেস-বামের মিলিত ভোট ছিল ১০.৭০ শতাংশ। কংগ্রেস একটি ওয়ার্ডে এগিয়েছিল। কংগ্রেসের সন্তোষ পাঠক মধ্য কলকাতায় তাঁর এলাকায় এগিয়ে ছিলেন। সিপিএম বা বামেরা কোথাও এগিয়েছিল না। যদিও গত পুরভোটে অর্থাৎ ২০১৫ সালে বামেরা ১৩টি ও কংগ্রেস ৫টি আসন জিতেছিল।
অর্থাৎ জয়ের ব্যাপারে তৃণমূলের কোনও সংশয় ছিল না। উল্টে বলা যায় লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্প চালু হওয়ার পরে তৃণমূল ১৩৫টি আসন জিতলেও অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। এক মাসও হয়নি আমরা আগরতলায় বিজেপির বিরোধীশূন্য পুরবোর্ড তৈরির খেলা দেখেছি। সেই ছবিই কলকাতায় দেখানোর কি খুব প্রয়োজনীয়তা ছিল?
এখানেই আসে গণতন্ত্রের কথা। তাহলে কি তৃণমূলের জমানায় অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভোট হওয়া সম্ভব নয়? এই প্রশ্নের উত্তর বাংলার মানুষ চায়। কারণ, এর পরেই হাওড়া, তারপরে রাজ্যের আরও প্রায় একশোটি পুরসভা এবং কিছু কর্পোরেশনের ভোট হবে।
মমতার কথাই এখনও দল ও সরকারের শেষ কথা হলেও আগামী দিনে নিশ্চিত ভাবেই ব্যাটন উঠবে অভিষেকের হাতে। আমরা ৩৪ বছরের সিপিএমকে দেখেছি। সাড়ে দশ বছরের তৃণমূলকেও দেখছি। বাম আমলেও বুথ দখল হতো। কিন্তু বহু পুরসভা বিরোধীরাও জিততো। বিশেষ করে জেলা সদরের পুরসভাগুলো। জ্যোতি বসু এবং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য দুই আমলেই এই দৃশ্য আমরা দেখেছি।
বিরোধীদের জায়গা না ছাড়লে শুধু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মৃত্যু হয় তাই নয়, শাসকের উপরেও মানুষের আস্থা চলে যায়। রাজ্যকে কি একেবারেই বিরোধীশূন্য করে দিতে চায় তৃণমূল? এর উত্তর কিন্তু অভিষেককেই খুঁজতে হবে।
(লেখকের ফেসবুক ওয়াল থেকে নেওয়া। মতামত লেখকের ব্যক্তিগত।)