প্রসূন আচার্য

পশ্চিমবঙ্গে কি পুলিশরাজ চলছে? এই রাজ্যে গণতান্ত্রিক ভাবে আন্দোলন করার ন্যূনতম কোনও অধিকার সাধারণ মানুষের নেই? কারণ, অবিলম্বে স্কুল কলেজ-সহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার দাবিতে আগাম জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রীকে ডেপুটেশন দিতে গেলেও ডেপুটেশন নেওয়া তো দূরের কথা, ডেপুটেশনকারীদের গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে! বৃহস্পতিবার বিধাননগরে এই ঘটনা ঘটেছে।
বুধবার উত্তরপ্রদেশের যোগী সরকারের পুলিশ বন্দুকের শক্তি দেখিয়ে এলাহাবাদ, বেনারস, গোরখপুরের বিভিন্ন হস্টেল থেকে ছাত্রদের বার করে পিটিয়েছিল। কারণ, তারা রেলের নিয়োগ পরীক্ষায় ‘গড়বড়’-এর অভিযোগ তুলে বিভিন্ন স্টেশনে বিক্ষোভ দেখিয়েছিল। বিহারের বেকার যুবকদের মতো উত্তরপ্রদেশের এই চাকরিপ্রার্থীরা কিন্তু ট্রেন জ্বালায়নি। ভোটে হেরে যাওয়ার ভয়ে উত্তরপ্রদেশের উপ-মুখ্যমন্ত্রী কেশব প্রসাদ মৌর্য ওই ছাত্রদের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলেছেন, যে সব পুলিশ ওই কাজ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শুধু তাই নয়, তিনি বিরোধী দলের কাছেও আগুনে ঘি না ঢালতে অনুরোধ করেছেন।
ক’দিন আগেও বিজেপি নেতাদের মুখে এমন কথা শোনা যেত না। এটা বলার একটাই কারণ, আমাদের সংবিধান প্রতিবাদ করাকে আমাদের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কোনও তৃণমূল, বিজেপি, সিপিএম বা কংগ্রেসের নেতা এই অধিকার কেড়ে নিতে পারেন না। কিন্তু রাষ্ট্র ক্ষমতায় উন্মত্ত হয়ে রাজনৈতিক নেতারা সে কথা ভুলে যান। এটা আমরা বার বার দেখেছি। বোধহয় পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসকেরাও তাই করছেন। ভোট এখনও অনেক দূরে। ফলে বিষয়টি নিয়ে তাঁরা ভাবছেন না।
অবিলম্বে স্কুল কলেজ খোলার দাবিতে ডেপুটেশন দেওয়ার কথা শিক্ষামন্ত্রীকে আগাম জানানো হয়েছিল। এই ব্যাপারে পুলিশের কাছেও লিখিত ভাবে জানানো হয়েছিল বলে গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতি (APDR)- এর নেতা রঞ্জিত সুর জানিয়েছেন। এ দিন বেলা ১২টা নাগাদ APDR এবং আরও কয়েকটি সংগঠনের প্রতিনিধিরা বিধাননগরের বিকাশ ভাবনে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে ডেপুটেশন দিতে যাবেন বলে কর্মসূচি নেওয়া হয়। তাঁদের জমায়েত হওয়ার কথা ছিল করুণাময়ীর মোড়ে। সেখান থেকে হেঁটে যাওয়ার কথা। অনেক সময়ই মন্ত্রী ডেপুটেশন নেন না। সেই ক্ষেত্রে কোনও সচিব নেন বা দফতরে জমা করে দিয়ে চলে আসা হয়। এটাই দস্তুর।
কিন্তু এই দিন ডেপুটেশন তো দূরের কথা, করুণাময়ীর মোড়ে কেউ অটো বা বাস থেকে নামলেই কোথায় যাবেন জিজ্ঞাসা করে পুলিশ তাঁকে ভ্যানে তুলে থানায় নিয়ে যায়। বেশ কয়েক জন শিক্ষক ও শিক্ষিকাও এই দিন ডেপুটেশন দিতে জমায়েত হয়েছিলেন। তাঁরাও চান শিক্ষাকেন্দ্র খুলুক। এ বার শিক্ষাকেন্দ্র খুলবে কিনা সেটা সরকারের ব্যাপার। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিদ্ধান্ত নেবেন। APDR এর রঞ্জিত সুর এবং আলতাফ আহমেদ দু’জনেই জানিয়েছেন, কিছু না বলেই পুলিশ উপস্থিত মহিলা ও পুরুষদের ধরে ধরে ভ্যানে তোলে। তারপরে তাঁদের থানায় নিয়ে যায়। দীর্ঘক্ষণ তাঁদের থানায় আটকে রেখে সন্ধায় ব্যক্তিগত জামিনে ছাড়া হয়।
আমার বিনম্র প্রশ্ন, এই রাজ্যে গণতান্ত্রিক অধিকার বলে কি কিছু আর অবশিষ্ট নেই? মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বা সচিব পদেও এখন কেউ নেই। তৃণমূলের জন্মের ২৫ বছর আগে জন্ম নেওয়া একটি মানবাধিকার সংগঠনের (APDR) শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার দাবিতে মন্ত্রীর কাছে ডেপুটেশন দিতে চেয়েছিল। সেই অধিকারও তাদের নেই? কোন অধিকারে তৃণমূল নেতৃত্ব ফ্যাসিস্ট বিজেপি শাসিত যোগীর রাজ্যের বিরুদ্ধে গলা ফাটায়?
রাজ্যের মানুষ সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট বিজেপির হাত থেকে রক্ষা পেতে তৃণমূলকে প্রায় ৫০ শতাংশ ভোট দিয়েছে। তার মানে এই নয়, তারা ছাড়া আর কেউ কোনও কথা বলবে না, আন্দোলন করবে না। এটা হতে পারে? অনেকেই মমতা সরকারের এই ধরনের কাজকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ফ্যাসিবাদী কাজ বলে উল্লেখ করছেন। তাঁদের মধ্যে একদা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সরকারের সময় গ্রেফতার হয়ে তৃণমূল আমলেও দীর্ঘদিন জেল খাটা নকশালপন্থী মানুষও আছেন।
তাঁদের বুঝতে হবে, মমতা বা তৃণমূল চাইলেও কখনও ফ্যাসিবাদী শক্তি হতে পারবে না। কেন পারবে না, তার অনেক কারণ আছে। একটা কারণ, আরএসএসের মতো ধর্মীয় মতাদর্শগত কোনও অবস্থান তৃণমূলের নেই। সারা দেশের ক্ষমতা হাতে নেই। দলের বিস্তার বা সংগঠনও নেই। এবং তার পিছনে রাষ্ট্রের সংবিধান পরিবর্তনের কোনও সুনির্দিষ্ট ডিজাইনও নেই। মুসলিম পাকিস্তানের ভয় দেখিয়ে উগ্র ও অন্ধ ন্যাশনালটি জাগানোর ক্ষমতা নেই। জার্মান জাতির মধ্যে হিটলার যা সৃষ্টি করেছিলেন।
সুতরাং মমতা সরকারের এই ধরনের কাজকে ফ্যাসিবাদী কাজ না বলে একটি অঙ্গ রাজ্যে গণতন্ত্রবিরোধী একনায়ক সুলভ মনোভাব বলা উচিত। যা নিন্দনীয়। রাজ্যের কোনও মিডিয়া কাল বা পরশু এ কথা বলবে কিনা জানি না। কিন্তু এই ভাবে পদে পদে প্রতিদিন গণতন্ত্রকে বিনষ্ট করলে আখেরে বিজেপির মতো চরম দক্ষিণপন্থী বা মাওবাদীদের মতো চরম বামপন্থী শক্তির আরও বড় উত্থান ঘটাবে। তখন আর বিজেপি ৭৭ আসনে আটকে থাকবে না। সেটা কি তৃণমূলের পক্ষে শুভ হবে? না রাজ্যের পক্ষে ভালো হবে?
এখন তো বাংলার প্রায় সব কবি, লেখক, নাট্যকার, সিনেমা পরিচালক, চিন্তাবিদ, বুদ্ধিজীবীরাই তৃণমূলপন্থী। অনেকেই বিভিন্ন আধা সরকারি পদে আসীন। তার জন্য আর্থানুকুল্যও পান। তাঁরা যেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, নিদেন পক্ষে দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে সে কথা বুঝিয়ে বলেন। হয়তো আশা করা বৃথা। তবুও বললাম।
(লেখাটি ফেসবুক থেকে নেওয়া। মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)