দেব প্রসাদ সান্যাল
শীতের আমেজ আছে। ভোরের শিশির আছে। শিশিরভেজা ঘাস আছে। গাছ আলো করে পলাশ আছে। বিকশিত কাঞ্চন আছে। আমের শাখায় মুকুল আছে। ক্ষেতে আছে যবের শিস। মোদ্দা কথা, দুয়ারে সরস্বতী। এ দিকে মুখে হাসি নেই করিমপুর ও লাগোয়া এলাকার মৃৎশিল্পীদের। তাঁরা সমস্বরে বলছেন, ‘‘কাঁটা সেই করোনা। সরস্বতীর প্রতিমা তৈরি করছি। কিন্তু লক্ষ্মীর দেখা মিলছে কই!’’
গত দু’বছর থেকে করোনার ধাক্কায় এলোমেলো হয়ে গিয়েছে সব। বাদ পড়েনি মূর্তি গড়ার কারখানাও। করোনা আবহে বাগদেবীর বন্দনা হয়েছে নমো নমো করে। এ বারেও বন্ধ রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ফলে স্বাভাবিক কারণেই উদ্বিগ্ন মৃৎশিল্পীরা। করিমপুর রামকৃষ্ণপল্লির মৃৎশিল্পী সনাতন পাল বলছেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত শুধু বালিয়াডাঙা গার্লস স্কুল থেকে একটামাত্র বায়না পেয়েছি। অথচ করোনার আগে এই সময়ে কুড়ি থেকে তিরিশটা প্রতিমার বায়না পেতাম। বাড়ির প্রতিমার বায়না পেয়েছি সাকুল্যে কুড়িটা। অন্য সময় আশি থেকে নব্বইটা প্রতিমার বায়না আসত। এমনটা চলতে থাকলে কারবার শিকেয় উঠবে।’’
করিমপুরের এক মৃৎশিল্পীর গলায় স্পষ্ট ক্ষোভ, ‘‘করোনা যেমন আছে, তেমন বিধিনিষেধও আছে। সে সব মেনে সব কিছুই তো হচ্ছে। এ দিকে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। সবচেয়ে বেশি বাগদেবীর আরাধনা যেখানে হয় সেই স্কুল, কলেজই যদি বন্ধ থাকে তা হলে এই সময়ে আমাদের কী অবস্থা হয়, বলুন তো!’’ ওই শিল্পীর সংযোজন, ‘‘স্বাভাবিক কারণেই প্রতিমার বায়না সে ভাবে আসেনি বললেই চলে। তবে ঝুঁকি নিয়ে বাড়ির পুজোর জন্য কিছু প্রতিমা তৈরি করে রাখছি। দেখা যাক, কী হয়!’’
মহিষাপাড়ার মৃৎশিল্পী প্রদীপ মালাকার বলছেন, ‘‘এই এক করোনা সব শেষ করে দিল। সরস্বতী পুজোর আর কয়েকটা দিন বাকি। এখনও কোনও বায়না আসেনি। শুধু আশায় বুক বেঁধে কয়েকটি প্রতিমা গড়ছি।’’ ধোড়াদহের শ্যামসুন্দর মালাকারের কথায়, ‘‘আমি কোনওদিনই বায়না না পেলে প্রতিমা তৈরি করি না। প্রতিমা তৈরির জিনিসপত্রের দাম বড্ড বেড়ে গিয়েছে। ফলে প্রতিমা বিক্রি না হলে বিপুল টাকার লোকসানে পড়তে হবে। গত বছর খুব খারাপ অবস্থা ছিল। এ বারে ভেবেছিলাম, পরিস্থিতি বদলাবে। কিন্তু কোথায় কী! সে ভাবে বায়নাই পেলাম না।’’
বাগদেবীর আরাধনার জন্য ফুলে, ফলে প্রকৃতি প্রস্তুত। কিন্তু মন ভালো নেই মৃৎশিল্পী ও ব্যবসায়ীদের। মন ভালো নেই খুদেদেরও। অন্য বার, পুজোর আগে আগে দলবেঁধে খুদেরা বেরিয়ে পড়ত রাস্তায়। হাতে থাকত চাঁদা তোলার সস্তার রসিদ-বই। আর মুখে খই ফুটত, ‘‘ও কাকু, তোমাকে কিন্তু দু’টাকা চাঁদা দিতেই হবে। আমরা বিরাট বড় করে পুজো করছি যে।’’ করোনার জুজুতে পথে দেখা মিলছে না সেই খুদেদেরও।
সব মিলিয়ে, বাগদেবীর আরাধনার সঙ্গে সঙ্গে লেপ্টে রয়েছে ভয়, উদ্বেগ আর অনিশ্চয়তা। এ বারেও!