লিপিকা বিশ্বাস সাহা

অতিমারির ঢেউ কাটিয়ে আবার ছন্দে ফিরছে জীবন। ছেলেমেয়েরা আবার স্কুলের আঙিনায় হুটোপুটি করে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আর ছোটোদের মজার মজার নালিশের ডালার সমাধানে আমরাও কাটিয়ে উঠছি গত দু’বছরের বিষাদযাপন। পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম শ্রেণি— সবারই এ বছর প্রথম হাইস্কুল। রোজই ক্লাস সেভেনের স্বপ্নীলকে নিয়েই অভিযোগ বেশি বেশি জমা পড়ে। কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল সে ‘একটু অন্যরকম। এই ‘একটু অন্যরকম’ সন্তানের পিতামাতা, স্বজনকে সমাজের তথাকথিত স্বাভাবিকদের তুল্য করে তুলতে তাদের কী লড়াই লড়তে হয় তা একমাত্র সেই লড়াকুরাই জানেন।
আসলে আমরা যারা নিজেদের স্বাভাবিক ভাবতে অভ্যস্ত, খ্যাদা-বোঁচা-পুঁটি-ক্ষেপি নামে খ্যাত একটু অন্যরকমদের নিয়ে হাসি, মজা করে আনন্দ পাই, আর এটাই হল আমাদের সামাজিক চিত্র। যদিও অন্য ভাবে সক্ষমদের প্রতি এই ধরনের আচরণ আইন দ্বারা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই অন্যরকমেরই একটা অংশ হল অটিস্টিক মানুষ। না, এরা কখনোই কোনও ভাবেই অক্ষম নন। ২০০৮ থেকে প্রতিবছর রাষ্ট্রসঙ্ঘ এপ্রিলের ২ তারিখকে অটিজম সম্পর্কে সচেতন করতে ‘বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস (ডব্লিউএএডি)’ হিসেবে পালন করছে। ২০২২ সালে এই দিবসের থিম ‘সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা’।
জানলে আকাশ থেকে পড়তে হয় আইনস্টাইন, আইজ্যাক নিউটন, মাইকেল অ্যাঞ্জেলো, মেরি কুরি, শ্রীনিবাস রামানুজন, বিল গেটস অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডারের (এএসডি) লক্ষণযুক্ত হয়েও তথাকথিত স্বাভাবিকদের তুলনায় ‘অসাধারণ-স্বাভাবিক’। আর এই তালিকাটি কিন্তু দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে খ্যাতি ও সাফল্যের দুনিয়ায়। ১৯৪০ সালে দার্জিলিংয়ে ভারতের প্রথম অটিজম শনাক্ত করেন ভিয়েনার এক শিশু বিশেষজ্ঞ এ রোনাল্ড। তার আগে এ ধরনের মানুষ অস্বাভাবিক হিসেবেই বিবেচিত হয়েছেন।

কলকাতার কাছেই বিশ্বমানের অটিজম টাউনশিপ গড়ে তোলার প্রস্তাবনা নেওয়া হয়েছে। যেখানে অটিস্টিক শিশু ও ব্যক্তি যাঁরা বিকাশজনিত সমস্যায়  ভুগছেন তাঁদের চিকিৎসা, প্রশিক্ষণ ও থাকার ব্যবস্থা করা হবে। তাছাড়া অভিভাবক ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। তাই আশার আলো কিছুটা হলেও দেখা যাচ্ছে।

স্বীকার না করে উপায় নেই, অটিজম শব্দটা সম্পর্কে আমাদের খুব একটা ধারণা নেই। যদিও এখন জনসচেতনতা কিছুটা  বৃদ্ধি পাওয়ায় এ সম্পর্কে জানার আগ্রহ বাড়ছে। তার প্রতিফলন সাম্প্রতিক কালের দু’একটি সিনেমায়ও দেখা গেছে। কিন্তু বাণিজ্যিক ভাবে সফল ওই সব সিনেমার প্রভাব হলের বাইরে সমাজের অন্দরে কতটা সে সম্পর্কে প্রশ্ন থেকেই যায়। তবে অবাক করা তথ্য অটিস্টিক শিশুর জন্মের হার ক্রমশ বাড়ছে। ২০১০ সালের পরবর্তী সময়ে এএসডি হিসেবে সনাক্ত হওয়া মানুষের সংখ্যা ৬% থেকে বেড়ে ১৫% হয়েছে। পৃথিবীতে ৭০ মিলিয়ন মানুষ অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার ভুক্ত, যার মধ্যে আশি শতাংশই উন্নয়নশীল দেশের নাগরিক। আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় প্রকাশ, ভারতে আনুমানিক ৬৮ জনে একজন অটিজমে আক্রান্ত। অর্থাৎ অটিজম জনসংখ্যা ১৮ মিলিয়ন হওয়ার সম্ভাবনা। তবে বাস্তব চিত্রটা কী বা কতটা ভয়াবহ সে সম্পর্কে গবেষণা ও অর্থ বিনিয়োগে পৃথিবীর অন্য উন্নত দেশগুলির তুলনায় ভারত অনেকটাই পিছিয়ে আছে।
ভারতের সামাজিক প্রেক্ষাপটে অটিজম চিহ্নিত করা খুব দুরূহ। অতিরিক্ত চঞ্চল, জেদি শিশুকে আমরা দস্যি বলি। আবার সমাজের সাথে মিশতে না পারা মুখচোরা ও লাজুক আচরণকে স্বাভাবিক মনে করি। ফলে অনেক সময়ই অটিজমের স্পষ্ট চিহ্নও চাপা পড়ে যায়। আসলে এই ধরনের শিশুরা নিষেধাত্মক আচরণ করে এবং অত্যধিক অনড় মনোভাব দেখায় তাদের আগ্রহ, কার্যক্রম ও ব্যবহারে। কিন্তু পরিজন ভেবে নেয় আদরে মাথায় উঠেছে। ধীরে শিখছে মানে বলা হয়, ‘মাথামোটা গোবর গণেশ, ওর দ্বারা কিচ্ছুটি হবে না’। ফলে অটিজমের লক্ষণগুলো সঠিক সময়ে শনাক্ত না হওয়ায় সঠিক পথ নির্বাচনে দেরি হয়ে যায়।
শুধু অভিভাবকেরা নন, প্রান্তিক অঞ্চলে একটি স্কুলে শিক্ষকতা করার সুবাদে বলি, এ-ব্যাপারে তেমন বিশেষ জ্ঞান না থাকার জন্য আমরাও পারি না ঠিক সময়ে একজন এসপার্জার সিনড্রোম বা অটিজম স্পেকট্রাম কন্ডিশন শিশুকে চিহ্নিত করতে। অভিজ্ঞতায় দেখেছি,  ক্লাস ফাইভের ছেলেকে যখন অনেকবার জিজ্ঞেস করার পরে তার নামের বানান লিখতে বললে বলে ‘ম্যাডাম, জি-এর পরে তুমি ‘তিন’ লেখো’, তখন সে হাসির খোরাক হয়। বুঝতে ক্ষণিক সময় লাগে তার নাম আসলে ‘জিত’। আর সে ‘তিন’ এবং ‘ত’-এর পার্থক্য বোঝে না। কিন্তু ‘কিছু না শিখে আসা ফাঁকিবাজ’ হিসাবে আখ্যায়িত কম কথা বলা এই উদাসমতী শিশুর ব্যাগ থেকে যখন বোতলের  ঢাকনা আর পেনের সামনের অংশ দিয়ে তারই বানানো একাধিক লাটিম ও কাগজ কেটে তৈরি অপূর্ব সব ফুল আবিস্কার হয় তখন সে ‘একটু অন্যরকম’ হিসেবেই বিবেচিত হয় মাত্র। আর এর বাইরে সাধারণ স্কুলে তার বিশেষ প্রাপ্তির ভাড়ার প্রায় শূন্য।
সব শিশুই ফুলের মতো নিষ্পাপ, সুন্দর। আত্মনিমগ্ন, বহির্বিমুখ অটিস্টিক শিশুরা নিজের চাহিদা, অনুভূতি, আবেগ সুন্দর ভাবে মন খুলে প্রকাশ করতে পারে না। এদের শব্দভান্ডার বেশি না থাকার জন্য একই কথা বারেবারে বলে। সাধারণ মানুষ যত সহজে বাইরের জগৎ থেকে আসা তথ্য ফিল্টার করতে পারে, একজন অটিস্টিক ব্যক্তি সেটা পারেন না। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই যে আচরণ স্বাভাবিক তার বিপরীত আচরণ দেখা যায়। তবে অনেক সময় দেখা যায়, একজন অটিস্টিক শিশু তার আগ্রহের বিষয়টিতে মেধা ও বুদ্ধিমত্ততার পরিচয় দেয়। কিন্তু ভারতবর্ষের মতো সাংস্কৃতিক বিভিন্নতাসম্পন্ন বহু ভাষাভাষী দেশে ভাষার তারতম্যের জটিলতার কারণে অটিস্টিক শিশুদের শিক্ষা অর্জনের প্রক্রিয়াটি যথেষ্ট কঠিন।
অটিজম কোনো বিরল বা অস্বাভাবিক ব্যাধি নয়। আজ পর্যন্ত অটিজমের কোনও নির্দিষ্ট জৈবিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। এটি একটি স্নায়বিক অবস্থা যা আচরণগত তারতম্যে প্রকাশ পায়। শিশুর জন্মের প্রথম তিন বছরের মধ্যেই তা ধরা পড়ে। এক সময় মায়ের  অবহেলা ও ব্যস্ততার জন্য শিশুর অটিজম হয়েছে বলে ধারণা করা হতো। তবে এ ধারণার পক্ষে বিজ্ঞানসম্মত সমর্থন পাওয়া যায়নি। তাছাড়া সন্তানদের তেমন কিছু হলে মায়ের উপর দোষ চাপিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ তো আমাদের সমাজে চালুই আছে। লজ্জাবোধ থেকে অনেকক্ষেত্রেই এই সব শিশুদের সামাজিক অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া থেকে পিতামাতাই বিরত থাকেন। তাদের সন্তানের অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার আছে সেটা সমাজ জানলে কী হবে সেই ভয়টাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি অজ্ঞানতার কারণে আত্মীয়-স্বজনরাও শিশুটিকে ‘অসামাজিক’, ‘পাগল’ প্রতিপন্ন করে নিজের শিশুটিকে তার সাথে মিশতে দেন না । সামাজিক ভাবে পরিবারটি একঘরে হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় শিশুটির  অবস্থা হয় আরও করুণ। এই অস্বীকার ও উপেক্ষা অটিজম স্পেকট্রাম কন্ডিশনকে আরও জটিল করে তোলে। অজ্ঞতা সব সময়ই সমস্যা সমাধানের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। অটিস্টিক শিশুর সঠিক চিকিৎসার পরিবর্তে অনেকেই আর একটি সন্তান নেওয়ার কথা ভাবেন বা নেন, ভবিষ্যতে তাদের দেখবে ও বংশ বজায় রাখবে এই আশায়। তবে ভয়ঙ্কর তথ্য হল সন্তানের প্রকৃত সমস্যাটি এড়িয়ে গিয়ে একে অপরকে দোষারোপ করে অনেকে দাম্পত্য বিচ্ছেদের সহজ পথে হাঁটেন।
ভারতে অটিজম আইনত স্বীকৃতি পায় ১৯৯৯ সালে যখন ন্যাচারাল ট্রাস্ট ফর দ্য ওয়েলফেয়ার অব পার্সনস উইথ অটিজম, সেরিব্রাল পালসি, মেন্টাল রিটারডেসন অ্যান্ড মাল্টিপল ডিসএবিলিটি অ্যাক্ট তৈরি হয়। যদিও আইন এই শিশুদের শিক্ষায় সমানাধিকার সুনিশ্চিত করার কথা বলে, তবে বাস্তবে অনেক স্কুলই এই আইনটিকে আমল দেয় না। আর বেশিরভাগ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায় এই অজুহাতে যে, আলাদা করে সময় দেওয়া সম্ভব নয়। ২০১৮ সালের ২০ ডিসেম্বর এই আইনের সংশোধনী বিল পাশ হয়েছে। খবরে প্রকাশ, কলকাতার কাছেই বিশ্বমানের অটিজম টাউনশিপ গড়ে তোলার প্রস্তাবনা নেওয়া হয়েছে। যেখানে অটিস্টিক শিশু ও ব্যক্তি যাঁরা বিকাশজনিত সমস্যায়  ভুগছেন তাঁদের চিকিৎসা, প্রশিক্ষণ ও থাকার ব্যবস্থা করা হবে। তাছাড়া অভিভাবক ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। তাই আশার আলো কিছুটা হলেও দেখা যাচ্ছে।
তবে বর্তমানে সমস্ত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বেশ কিছু কুর্নিশযোগ্য স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা অটিস্টিক ব্যক্তিদের সাহায্যার্থে অক্লান্ত পরিশ্রমও চেষ্টা করে চলেছেন। যাতে থেরাপি বা ট্রেনিং-এর মাধ্যমে এই মানুষরা মূলস্রোতে মিশতে পারে। বলা বাহুল্য, এই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির বেশিরভাগই তৈরি হয়েছে আটিজম আক্রান্ত শিশুদের সচেতন অবিভাবকদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়। তবে অধিকাংশ সংস্থার কার্যকলাপ শহরকেন্দ্রিক হওয়ায় আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলে অটিজম আক্রান্তের প্রকৃত চিত্রটা এখনও স্পষ্ট নয়। এছাড়া অজ্ঞতা, সামাজিক জড়তা, গ্রামাঞ্চলে সঠিক চিকিৎসার অভাব নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের ব্যয়বহুল চিকিৎসার সুযোগ নিতে না পারার মতো চিরাচরিত কারণগুলো তো আছেই।
এই চিত্রটাকে সঠিক ভাবে বুঝতে গেলে এবং শৈশবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অটিজম নির্ণয় করতে গেলে আগে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। সর্বাগ্রে তার জন্য দরকার ব্যাপক হারে প্রচার অভিযান, গণমাধ্যমের ব্যবহার ও ওয়ার্কশপ। গ্রামাঞ্চলের সঠিক তথ্য প্রকাশ পেলে একমাত্র তখনই ভারতবর্ষের অটিজম চিত্রটি পরিষ্কার হবে, পরিস্থিতির গভীরতা জানা যাবে।
তবে সমাজের সচেতনতাই এই সমস্যার প্রথম ও প্রধান সমাধান সূত্র। একটি অটিজম শিশু আপনার আমার মতো সমাজের বেঁধে দেওয়া ছন্দে ভাবছে না— এর মানে এই নয় যে, সে তার জীবন অতিবাহিত করতে পারবে না। উপেক্ষা নয়, সহমর্মিতা ও সাহচর্যের মানসিকতাই অটিস্টিক ব্যক্তিদের স্বাভাবিক জীবনছন্দে ফিরিয়ে আনতে পারে। আর তবেই তো এই পৃথিবী সবার জন্য সমান ভাবে বাসযোগ্য হয়ে উঠবে। তবেই তো এই সব আত্মমগ্ন মানুষ জীবনে সঠিক উড়ান দিতে পারবে। আর আমরাও গাইতে পারব— আমরা করেছি জয়। আসুন, অটিজম সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে সহমর্মী হতে আমরা ‘কালার অফ ব্লু’-এর সমর্থনে পথ হাঁটি…

(লেখক শিকারপুর উচ্চ উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)