—ওই দ্যাখ, অনির্বাণ!
—কে?
—ওরে অনির্বাণ… অনির্বাণ!
—অনির্বাণ… মানে?
—অনির্বাণ ভট্টাচার্য… ‘কিচ্ছু চাই না আমি’, ‘মন্দার’…. সেই অনির্বাণ…
—কী বলছিস? ঢপ দিচ্ছিস না তো?
—আরে না রে বাবা, না।
গত বেশ কয়েকদিন ধরে করিমপুরে কান পাতলে এমন কথোপকথনই শোনা গিয়েছে। কেউ তাঁকে দেখেছেন ‘মর্নিং ওয়াক’-এ গিয়ে। কেউ দেখেছেন বাজার করতে করতে। কেউ দেখেছেন করিমপুর থেকে নাটনা মোড়ের দিকের যাওয়া কোনও গাড়িতে।
ব্যাপারটা কী?
সত্যিই কি অনির্বাণ ভট্টাচার্য করিমপুরে এসেছেন?
আর যদি এসেই থাকেন, তা হলে কেন?
টলিউড সূত্রের খবর, প্রথম দুটো প্রশ্নের উত্তর— হ্যাঁ, অনির্বাণ ভট্টাচার্য করিমপুরে এসেছেন। আর তার পরের প্রশ্নের উত্তর— এসেছেন শুটিংয়ের জন্য।
সেই কবে অভিনেতা, গায়ক, চিত্র পরিচালক অঞ্জন দত্ত ‘অসময়’-এ গেয়েছিলেন, ‘‘বাদল সরকারের মিছিলে দাঁড়িয়ে হারিয়ে গেলাম কে কোথায়…’। এত বছর পরে সেই বাদল সরকারেরই হাত ধরে করিমপুরে পা রেখেছেন এ কালের জনপ্রিয় অভিনেতা, পরিচালক অনির্বাণ ভট্টাচার্য।
আরও একটু বিশদে বললে, অনির্বাণ তাঁর ছবির শুটিং করছেন যমশেরপুরের বাগচীবাড়িতে। হ্যাঁ, ব্লক করিমপুর। থানা হোগলবেড়িয়া। আর গ্রামটার নাম যমশেরপুর। এই গ্রামের বাড়িতে বসেই ‘মাগো আমার শোলক্-বলা কাজলা দিদি কই?’ লিখেছিলেন যতীন্দ্রমোহন বাগচী।
বছরে একবার দুর্গাপুজো উপলক্ষে ওই বাড়িতে ভিড়, হইচই দেখে অভ্যস্ত গ্রামের মানুষ। তবে গত কয়েকদিন ধরে সেই গ্রাম বিলকুল বদলে গিয়েছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গমগম করছে ভিড়। কেউ চান অটোগ্রাফ, কারও আবদার— সেলফি। অনির্বাণ হাসিমুখেই সে সব সামলেছেন।
এত বড় ‘স্টার’ বলে কথা! তাঁর ছবির শুটিংয়ে পুলিশি পাহারাও রয়েছে। হোগলবেড়িয়া থানার দু’-একজন সিভিক ভলান্টিয়ার ভিড় দেখলে হইহই করেছেন বটে, তবে ওইটুকুই! ‘মন্দার’-এর মুকাদ্দার মুখার্জী কাউকেই নিরাশ করেননি।
স্থানীয় লোকজন জানাচ্ছেন, যমশেরপুরের বাগচীবাড়ি নিয়ে একটা উন্মাদনা বরাবরই আছে। কিন্তু অনির্বাণ আসার আগে এমন ‘হইহই কাণ্ড…রইরই ব্যাপার’ শেষ কবে হয়েছে মনে করতে পারছেন না প্রবীণেরাও।
জানা গিয়েছে, বাদল সরকারের নাটক ‘বল্লভপুরের রূপকথা’ চলচ্চিত্রে ফুটিয়ে তুলছেন অনির্বাণ। তারই শুটিংয়ের অন্যতম স্থান হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছেন প্রান্তিক এই এলাকার যমশেরপুরের বাগচীবাড়ি। এসভিএফের প্রযোজনায় বন্ধু প্রতীক দত্তকে সঙ্গে নিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ে যাচ্ছেন অনির্বাণ। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী অক্টোবর মাসে এই ছবি মুক্তি পাবে।
বাদল সরকারের ‘বল্লভপুরের রূপকথা’ নাটকটি রূপকধর্মী। কয়েকশো বছরের জীর্ণ এক রাজবাড়ির ভগ্নস্তুপকে সামনে রেখে এই নাটক। সেখানে রয়েছে সামন্ততান্ত্রিক বুনোট, ঠুনকো আভিজাত্য, জটিল জীবনযাপন। রঘুপতি নামে এক চরিত্র বিশেষ ভূমিকায় অভিনয় করে চলে। একদিকে অহঙ্কারের ‘ব্লু ব্লাড’, অন্যদিকে টনটনে বাস্তব। এ সব নিয়েই ছিল ‘বল্লভপুরের রূপকথা’ নাটক। সেই নাটককে সিনেমায় কী ভাবে এবং কেমন ভাবে তুলে ধরবেন অনির্বাণ ও তাঁর টিমের সদস্যেরা, সেটাই দেখার।
তবে করিমপুর ও লাগোয়া এলাকা সে সব নিয়ে বিশেষ ভাবিত নয়। তাঁদের কাছে অনির্বাণ মানে সেই ‘স্টার’, যাঁকে ছোঁয়া যায়, ধরা যায় এবং চেষ্টা করলে মিলেও যায় একটা ‘সেলফি’ কিংবা ‘অটোগ্রাফ’। অনির্বাণ মানে সেই ছেলেটা যিনি অনায়াসেই গেয়ে উঠতে পারেন, ‘কিচ্ছু চাইনি আমি আজীবন ভালোবাসা ছাড়া’। অনির্বাণ মানে ‘ভিঞ্চি দা’-র সেই ‘বিজয় পোদ্দার’ যিনি সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে দু’বার ভাবেন না। অনির্বাণ মানে ‘বিবাহ অভিযান’-এর সেই বুলেট সিং, ‘দ্বিতীয় পুরুষ’-এর খোকা, এবং আরও…
সেই অনির্বাণ করিমপুরে!
স্থানীয় এক স্কুলের প্রধানশিক্ষক বলছেন, ‘‘আমি তো মশাই, অনির্বাণের অন্ধ ভক্ত! দু’দিন আগে রেগুলেটেড মার্কেটের মাঠে হাঁটতে গিয়েছি। ফেরার পথে দেখছি, ‘কিসান ভবন’-এর নীচে বারমুডা পরে দাঁড়িয়ে আছেন অনির্বাণ! প্রথমে তো নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারিনি। পরে শুনলাম, অনির্বাণ কোনও একটা ছবির শুটিংয়ে এখানে এসেছেন!’’
করিমপুরের এক হোটেল ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউটের কর্ণধার প্রণয় চট্টোপাধ্যায়ের গলায় আক্ষেপের সুর স্পষ্ট, ‘‘আজ ক’দিন ধরেই ঘুরছি অনির্বাণের সঙ্গে একটা সেল্ফি তুলব বলে! কিন্তু যাঁর সঙ্গে গিয়েছিলাম সে জেদ ধরল, অনুমতি না নিয়ে শুটিং স্পটে ঢুকবে না। তার পাল্লায় পড়ে আমার সেল্ফিটা আর তোলা হল না। ভিড়টা একটু ঠেলে এগিয়ে গেলেই অনির্বাণ না করতেন না।’’
আর যাঁরা সে সুযোগ থেকে যাঁরা বঞ্চিত হননি তাঁদের যেন আনন্দের সীমা নেই। তাঁরা বলছেন, ‘‘এত বড় অভিনেতা, এত বড় পরিচালক! কিন্তু এতটুকু অহঙ্কার নেই, জানেন! অনির্বাণ শুধু ছবিতেই নয়, ছবির বাইরেও একজন অসাধারণ মানুষ।’’
সীমান্ত ঘেঁষা করিমপুরে আপাতত রিল আর রিয়াল মিলেমিশে একাকার। যাঁদের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েছে তাঁরা আবার দেখা করতে চান, আর যাঁদের শিকে এখনও ছেঁড়েনি তাঁরা জানতে চাইছেন, ‘‘আচ্ছা, অনির্বাণ আর কদ্দিন যেন এখানে আছেন…’’