অনল আবেদিন
ব্রহ্মাণ্ডের বিষাক্ততম বিষটির নাম সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ। ঘৃণা তার মূল উপাদান। অপরকে ঘৃণা করা। উপযুক্ত সেচ-সার পেলে ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, লিঙ্গ ও ভৌগোলিক অবস্থানের ভিন্নতাকে আশ্রয় করে এই ঘৃণ্যতম মারণ রোগ সভ্যতার শিকড়ে পৌঁছে যায়। তারপর সভ্যতাকে সমূলে উৎপাটন করতে সক্রিয় হয়। সেই ব্যাধি কোনও কোনও ব্যক্তি ও সংস্থার ক্ষেত্রে প্রায় সময়ই বিষম রকমের প্রকট হয়ে থাকে। আবার অনেকের তথাকথিত অসাম্প্রদায়িক মুখোশের আড়ালে অন্তঃসলিলার মতো অপ্রকট আকারে ক্রিয়াশীল থাকে। প্রথমটার তুলনায় দ্বিতীয়টা বেশি খতরনাক। অনুকূল সময় ও সুযোগ পেলে সেই বিষাক্ত ফণা ফোঁস করে। কবি কাজি নজরুল ইসলামকে নিয়ে পদ্মার দুই পারের দুই বাংলাতে, দুই ভিন্ন শিবিরের মধ্যে প্রকাশ্য সাম্প্রদায়িকতার পাশাপাশি এই সুপ্ত সাম্প্রদায়িকতার চর্চাও অনেক দিন ধরে ক্রিয়াশীল। সেই সূত্র ধরে, আহাম্মকের মতো প্রচার করা হয়, “রবীন্দ্রনাথকে বড় করে দেখাতে চাওয়ায় নজরুলকে পাত্তা দেওয়া হয়নি! রবীন্দ্রনাথের থেকে বড় প্রতিভাধর হওয়া সত্ত্বেও সাম্প্রদায়িকতার কারণে নজরুলকে চেপে দেওয়া হয়েছে।”
কখনও কোনও ক্ষেত্রে নজরুল পক্ষপাতের বলি হননি, এমনটি হলফ করে বলা যাবে না ঠিকই৷ এমনকি কোনও কোনও ক্ষেত্রে স্রেফ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার কারণে ও শ্রেণিস্বার্থ রক্ষার তাগিদে বিদ্রোহী কবির প্রতিভার প্রতি অবিচার করা হয়েছে। তবুও এমন অভিযোগকে পাত্তা না-দেওয়া ছাড়া অন্য কোনও গতি নেই। কারণ, নজরুলের প্রতিভা বিকশিত হতে ভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের গুণীজনদের বরাভয়, স্নেহ ও সহযোগিতা অপরিমেয় পরিমাণে সত্য। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল— দু’ জন শিল্পীর শিল্প সাধনার কালসীমা ও তাঁদের শৈল্পিক ঘরাণার মধ্যে ফারাক বিস্তর। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির কালসীমা সমুদ্রের মতো বিস্তৃত ও আকাশের মতো অসীম। আর নজরুলের শিল্পকর্মের সময়সীমা পদ্মার মতো বিস্তৃত ও উচ্ছল, গঙ্গার মতো স্মিত ও বটবৃক্ষের মতো সীমায়িত মহীরূহ। তাছাড়া রবীন্দ্র-নজরুলের পরস্পরের প্রতি গভীর ও আন্তরিক স্নেহ-শ্রদ্ধার সম্পর্কই পক্ষপাতিত্বের দুর্বল অভিযোগের সারবত্তা সমূলে নস্যাৎ করে দেয়। তবে দু’ জনেই একনিষ্ঠ মানবপ্রেমী।
সময়টা ১৯২২ সাল। নজরুলের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’। সেই উদ্যোগের প্রতি রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাণী, “আয় চলে আয় ধূমকেতু,/ আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু/ দুর্দিনে এই দুর্গ শিরে/ উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।/ অলক্ষণের তিলক রেখা,/ রাতের ভালে হোক না লেখা/ জাগিয়ে দেরে ধমক মেরে/ আছে যারা অর্ধচেতন।…” ওই পত্রিকাতেই প্রকাশিত নজরুলের ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতার জন্য ১৯২২ সালের ২৩ নভেম্বর কুমিল্লা থেকে কবিকে গ্রেফতার করে ব্রিটিশরাজের পুলিশ। উল্লেখ্য, বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনার ‘অপরাধে’, রাজদ্রোহে অভিযুক্ত হয়ে প্রথম যাঁকে কারাবন্দি হতে হয় তিনি কবি নজরুল। তার আগে অন্য কোনও বাঙালি লেখক-কবিকে রাজদ্রোহে গ্রেফতার হতে হয়নি। কুমিল্লা থেকে তাঁকে প্রথমে আনা হয় কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে। আদালতে পেশ করার জন্য সেই জেলে বসেই তিনি লেখেন বিখ্যাত ‘রাজবন্দীর জবানবন্দি’। ১৯২৩ সালের ১৬ জানুয়ারি বিচারক সুইন হো নজরুলকে এক বছর কারাদণ্ড দেন। প্রেসিডেন্সি জেল থেকে নজরুলকে এবার আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে স্থানান্তরিত করা হয়।
রাজদ্রোহের শাস্তি হিসাবে কারাদণ্ড হয়েছে শুনে প্রমীলা সেনগুপ্তের (তখনও নজরুলের সঙ্গে বিয়ে হয়নি) কাকিমা, তথা নজরুলের মাতৃসম বিরজাসুন্দরী দেবী ভীষণ বেদনাহত হন। তিনি ‘শ্রীমান কাজী নজরুল ইসলাম’ নামে একটি কবিতা লেখেন। সেটি ‘ধূমকেতু’র ১৯২৩ সালের ২৭ জানুয়ারির সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। কবিতাটিতে তিনি লেখেন, “ওরে লক্ষ্মীছাড়া ছেলে—/ আমার এ বেদন ভরা বুকের মাঝে/ জাগিয়ে দিলি নতুন ব্যথা/ ‘মা’ ‘মা’ বলে কাছে এসে। আবার কবে কইবি কথা।…/ একি শুনি!! গেছিস নাকি/ শিকল দেবীর পুজায় চলে/ অশ্রু নয় আশিস ধারা। অবিরত পড়বে রে তোর শিরে/ শঙ্কা কিসের! যাও তবে যাও/ অলক্ষণের বিজয়টিকা পরে/ হেথা বাজুক তোমার অগ্নি বীণা/ আসন টুটুক সুরে…/ মায়ের আশিস বর্মসম/ রক্ষা করুক তোরে।”
আলিপুর জেল থেকে ১৯২৩ সালে ১৪ এপ্রিল নজরুলকে নিয়ে যাওয়া হয় হুগলি জেলে। সেই জেলের উৎপীড়ক সুপার আর্সটানের রাজবন্দিদের উপর অত্যাচার ছিল লাগামছাড়া। সেই অত্যাচারের বিরুদ্ধে নজরুল অনশন শুরু করেন। আজকের দিনের গোপনে স্যান্ডউইচ-বার্গার খাওয়া অনশন অবশ্য নয়। অনশনরত নজরুল ক্রমে মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়েন। চিন্তিত হয়ে পড়েন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চিত্তরঞ্জন দাশ, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অতুল্য সেন, যতীন্দ্রমোহন, মওলানা মণিরুজ্জামান- সহ দলমত নির্বিশেষ শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি ও রাজনীতিকরা। অনশন তুলে নেওয়ার জন্য উদ্বিগ্ন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জেলবন্দি নজরুলকে টেলিগ্রাম পাঠালেন। টেলিগ্রাম ফিরে এল। উদ্বিগ্ন কবিগুরু তাঁর পুত্রকে লেখেন, “কল্যাণীয়াসু রথী, নজরুল ইসলামকে প্রেসিডেন্সি জেলের ঠিকানায় টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলাম, লিখেছিলাম, ‘Give up hunger strike, our Literature claims you.’ জেল থেকে Memo এসেছে, ‘The Addressee not found’. Message ওকে দিতে চায় না, কেন না নজরুল প্রেসিডেন্সি জেলে না থাকলেও ওরা নিশ্চয় জানে সে কোথায় আছে। অর্থাৎ নজরুল ইসলামের আত্মহত্যায় ওরা বাধা দিতে চায় না।”
চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে কলকাতার গোলদিঘি ময়দানে (কলেজ স্কোয়ার) এক বিশাল জনসভায় প্রস্তাব নেওয়া হয়, ‘নজরুলকে বাংলাদেশের ও সাহিত্যের প্রয়োজনে বাঁচানো প্রয়োজন।’ অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অনশন ভাঙাতে নজরুলকে নিমরাজি করানো হয়। প্রমীলার কাকিমা বিরজাসুন্দরী দেবী হুগলি জেলের ভিতরে গিয়ে ১৯২৩ সালের ২২ মে অনশনের ৩৯তম (তৃণমূল নেত্রীর ২৬ দিনের থেকে ১৩ দিন বেশি) দিনে লেবুর রস খাইয়ে নজরুলের অনশনে ছেদ টানেন। জেল থেকে বেরিয়ে বিরজাসুন্দরী দেবী বলেন, “খাইয়েছি পাগলকে। কথা কী শোনে! মরার মতো নেতিয়ে পড়েছে শরীর, গলা চি চি করছে। কথা কি শোনে! বলে, না অন্যায় আমি সইব না। শেষ পর্যন্ত আমি হুকুম দিলাম, আমি মা, মায়ের আদেশ সব ন্যায় অন্যায়ের উর্ধ্বে। চুপ করে গেল। তারপর বলল, দাও কী খেতে দেবে। নিজে হাতে নেবুর রস খাইয়ে এসেছি।” বিরজাদেবীর প্রয়াত দেবরের মেয়ে প্রমীলার সঙ্গে তখনও নজরুলের বিয়ে হয়নি। সবে তখন পূর্বরাগ অতিক্রম করে অনুরাগ পর্বের শুরু। এমন সময় বিদ্রোহী কবিকে জেলবন্দি করা হয়।
অনশন ভাঙার সপ্তাহ তিনেক পরে ১৮ জুন নজরুলকে হুগলি জেল থেকে বহরমপুর জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। মুর্শিদাবাদ জেলায় এই তাঁর প্রথম পদার্পণ। বন্দি অবস্থায়। এখন যেটা বহরমপুর মানসিক হাসপাতাল, তখন সেটা ছিল জেল। সেই জেলের পশ্চিমপ্রান্তে গঙ্গাপাড়ের দিকের একটি ঘর ছিল নজরুলের জন্য বরাদ্দ। জেলের নিয়ম অনুসারে সঙ্গীতজ্ঞ রাজবন্দিকে দেওয়া হয়েছিল হারমোনিয়াম। বন্দিরা বিপ্লবী বাঘা যতীনের নেতৃত্বে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধের স্মরণে ‘বালেশ্বর বলিদান’ স্মরণদিবস অনুষ্ঠান করেন এই জেলের ভিতরেই। মৌলানা সুফির সভাপতিত্বে নজরুল, পূর্ণ দাস, অমরেশ কাঞ্জিলাল, প্রমুখ কয়েদিরা সম্মিলীত ভাবে সেই অনুষ্ঠান করেন। সেই অনুষ্ঠানে নজরুল গেয়েছিলেন, “এক বার বিদায় দে মা…”। সহজাত টানে জেলের ভিতরে বসে প্রতি দিন সকালে নজরুল উদাত্ত কণ্ঠে গান গাইতেন। জেলের পশ্চিম দিকে ভাগীরথী পাড়ের উঁচু বাঁধে দাঁড়িয়ে অনেকেই নজরুলের কণ্ঠ থেকে উৎসারিত ‘কারার ঐ লৌহ কপাট…’, ‘রক্ত নিশি ভোরে…’, ‘শিকল পরার ছল…’ প্রভৃতি গান শুনতেন। সেই শ্রোতাদের মধ্যে ছিলেন বহরমপুরের কাদাই ভট্টাচার্য পাড়ার যৌবনের দূত, সুরের একনিষ্ঠ সাধক, সঙ্গীতশিল্পী উমাপদ ভট্টাচার্য। মহামহোপাধ্যায় শ্রীরাম শিরোমনির নাতি, ইংরাজি সাহিত্যে এমএ উমাপদ পরবর্তী জীবনে হয়ে উঠেন নজরুল সঙ্গীতের ‘ভগীরথ’ ও নজরুলের ‘ফেনুদা’।
বহরমপুরে জেল-আইন ভাঙার অভিযোগে বন্দি নজরুল অভিযুক্ত হন। দুই কংগ্রেস নেতা, তথা আইনজীবী ব্রজভূষণ গুপ্ত ও জ্ঞান সরকারের নেতৃত্বে একদল আইনজীবীর চেষ্টায় সেই অভিযোগ থেকে নজরুল বেকসুর খালাস পান। ১৯২৩ সালে ১৫ ডিসেম্বর বহরমপুর জেল থেকে তিনি মুক্তি পান। জেলের ফটক থেকে নজরুল বের হতেই ভিড় সরিয়ে বকুল ফুলের শুকনো একটি মালা নিয়ে এগিয়ে যান উমাপদ ভট্টাচার্য। শুকনো সেই মালা তিনি পরিয়ে দেন নজরুলের গলায়। প্রমীলা দেবী ছিলেন বহরমপুরের উমাপদ ভট্টাচার্য ও তাঁর স্ত্রী গায়ত্রী দেবীর পূর্ব পরিচিত। হঠাৎ প্রমীলার কাছ থেকে বহরমপুরের গায়ত্রীর কাছে একটি মোটা খাম পৌঁছয়। খামের ভিতরে ছিল বকুল ফুলের একটি মালা। সঙ্গে চিরকুট। চিরকুটে লেখা, “মুক্তি মুহূর্তে নজরুল পায় যেন আমার ভক্তিপ্রণত অর্ঘ।” প্রমীলার সেই বাসনা আক্ষরিক অর্থেই পূর্ণ করেছিলেন উমাপদ ভট্টচার্য।
কৃষ্ণনাথ কলেজ তখন ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অন্যতম ডেরা। কলেজের একদল ছাত্র মিছিল করে জেলমুক্ত নজরুলকে নিয়ে যান বহরমপুর শহরের গোরাবাজার এলাকার ৫৬ নম্বর মহেন্দ্র মুখার্জি রোডের ‘সায়েন্স কটেজ’ নামে কলেজ ছাত্রদের মেসে। সেখানে কবিকে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। ওই দিনই সেখান থেকে কবিকে নিয়ে যাওয়া হয় বহরমপুরের বিশিষ্ট আইনজীবী রজনীকান্ত সান্যালের বাড়ি। রজনীকান্তের প্রতিভাধর সন্তান নলিনাক্ষ ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী ও নজরুলের অকৃত্রিম বন্ধু। নলিনাক্ষের খুড়তুতো ভাই শশাঙ্কশেখর সান্যাল ছিলেন নজরুলের ভাতৃপ্রতিম। সান্যাল বাড়ি থেকে ওই দিনই নজরুলকে নিয়ে যাওয়া হয় বহরমপুর শহরের কাদাই ভট্টাচার্য পাড়ায় উমাপদ ভট্টাচার্যের বাড়ি। সেই থেকে ১৯২৪ সালে হুগলিতে বসবাস শুরু না-করা পর্যন্ত নজরুলের জীবনের অন্যতম আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠেছিল এই ‘গোঁড়া’ ভট্টাচার্য পরিবার। নজরুলের সঙ্গে বহরমপুরের বরাট পরিবারেরও ছিল দারুণ সখ্য। বন্ধুত্ব ও সঙ্গীতের প্রয়োজনে বহরমপুর ছাড়াও মুর্শিদাবাদ জেলার নিমতিতা, জগতাই, লালবাগ, জিয়াগঞ্জ ও লালগোলা চষে বেড়িছিলেন বিদ্রোহী কবি।
সান্যাল ও ভট্টাচার্য পরিবারের মধ্যে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে নজরুলের ঘটকালিতে ১৯২৪ সালের ১৮ এপ্রিল উমাপদ ভট্টাচার্যের পরিবারের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হয় নলিনাক্ষের। মুসলমান তো কোন ছার! তখন বর্ণবাদী হিন্দু সমাজে বামুন, কায়েত ও বৈদ্যদেরও একত্রে পঙক্তি (সবাই এক সঙ্গে বসে) ভোজন নিষিদ্ধ ছিল। ফলে রাতের বেলায় ছোঁয়াছুৃয়ি বাঁচাতে কবিকে এক পঙক্তির বদলে উমাপদর শরিক শরৎচন্দ্র ভট্টাচার্যের বাড়িতে পৃথক স্থানে খেতে দেওয়া হয়েছিল। তাই দেখে ক্ষুব্ধ শশাঙ্কশেখর সান্যাল বিয়ের আসরে গিয়ে নলিনাক্ষকে বলেন, ”দাদা চল! এ বিয়ে হবে না। আলাদা ভাবে খেতে দিয়ে কাজিদাকে এঁরা অপমান করেছে।” ফলে বিয়ে ভণ্ডুল হতে বসেছিল। কাজি কবির বহু অনুরোধে কোনও মতে বিয়ে সম্পন্ন হয়। সেই রাতেই কবি লেখেন, “জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াত খেলছে জুয়া/ ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয়তো মোয়া।।/ হুঁকোর জল আর ভাতের হাঁড়ি, ভাবলি এতেই জাতির জান,/ তাইতো বেকুব, করলি তোরা এক জাতিকে একশোখান!/ এখন দেখিস ভারতজোড়া পচে আছিস বাসি মরা,/ মানুষ নাই আজ, আছে শুধু জাত-শেয়ালের হুক্কাহুয়া।।… বলতে পারিস বিশ্বপিতা ভগবানের কোন সে জাত?/ কোন ছেলের তাঁর লাগলে ছোঁয়া অশুচি হন জগন্নাথ?/ নারায়ণের জাত যদি নাই,/ তোদের কেন জাতের বালাই?/ (তোরা) ছেলের মুখে থুতু দিয়ে মার মুখে দিস ধূপের ধোঁয়া।।…”
ভোররাতে নজরুলের অশ্রুস্নাত কণ্ঠে এই গান শুনে বিয়েবাড়ির গোঁড়া হিন্দুদের সম্বিৎ ফেরে। জাতপাতের বিভেদ দূর হয়। বৌভাতের দিন সান্যাল পরিবারে বৈপ্লবিক ঘটনা ঘটে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষ হিন্দু-মুসলমান সবার এক পঙক্তিতে বৌভাতে ভোজনের ব্যবস্থা করা হয়। সেকালের প্রেক্ষিতে তা ছিল অকল্পনীয়। খাওয়ার আগে এক পঙক্তিতে উপবিষ্ট নলিনাক্ষের পাশে বসে নলিনাক্ষের অনুরোধে নজরুলকে ‘জাতের নামে বজ্জাতি…’ সুর করে গাইতে হয়। পরিণামে সান্যাল পরিবারকে একঘরে করেছিল শতবর্ষ আগের প্রাচীন সমাজপতিরা। মুর্শিদাবাদ জেলার সুতি থানার নিমতিতা-জগতাই গ্রামের নলিনীকান্ত সরকার ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী, গায়ক, সুরকার ও নজরুলের অভিন্নহৃদয় বন্ধু। সেই বন্ধুর আমন্ত্রণে ১৯২৮ সালে জগতাই লাগোয়া নিমতিতার জমিদার জ্ঞানেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর মেয়ের সঙ্গে কলকাতার আইনজীবীরা যতীশচন্দ্র রায়ের পুত্র শৈলেশচন্দ্রের বিয়ের বরযাত্রী গিয়েছিলেন কাজি নজরুল। সেখানেও নজরুলের সঙ্গীতের সুরের তোড়ে যুগযুগান্ত লালিত জাতপাতের বেড়া ভেঙে পড়েছিল। সেখানেই লালগোলা এম এন অ্যাকাডেমির প্রধানশিক্ষক যোগীবর বরদাচরণ মজুমদারের সঙ্গে নজরুলের প্রথম পরিচয়।
পরবর্তী জীবনে নজরুল এই যোগগুরুর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। লালগোলার মহারাজা যোগীন্দ্রনারায়ণ রায়ের রাজপ্রাসাদের। কালীমন্দিরে যাতায়াত শুরু করেন। নজরুলের শ্যামাসংগীত রচনার অন্যতম প্রেরণাস্থল হয়ে উঠেছিল যোগগুরু বরদাচরণ মজুমদারের শিষ্যত্ব ও তাঁর সাধনার মন্দির এবং সেই সঙ্গে লালগোলার মহারাজা যোগীন্দ্রনারায়ণ রায়ের মন্দিরের শৃঙ্খলিত কালীপ্রতিমা। বরদাচরণ মজুমদার লিখিত একটি যোগগ্রন্থের ভূমিকাও লিখেছিলেন নজরুল। নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত, ভজন, কীর্তন ও ইসলামি সঙ্গীত মিলে ৫০১টি গানের নির্বাচিত একটি সংকলন গ্রন্থের নাম ‘ভক্তিগীতি মাধুরী’। ভূমিকায় সেই গ্রন্থকে কবি গীতার (গ্রন্থ-গীতা) সঙ্গে তুলনা করেছেন এবং বরদাচরণ মজুমদারকে এই ‘গ্রন্থ-গীতার উদ্গাতা’ বলেছেন। অর্থাৎ অনুপ্রেেরণা। নজরুল এ ভাবেই বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে সমন্বয়ের ভাবনা ভেবেছিলেন। কিন্ত সেই ভাবনা বেশি দূর অগ্রসর হওয়ার আগেই রোগাক্রান্ত কবি কথা বলার ক্ষমতা চিরতরে হারিয়ে ফেলেন।
আগেই বলেছি, বহরমপুর জেল থেকে বের হয়ে হুগলিতে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু না-করা পর্যন্ত বহরমপুরের কাদাই ভট্টাচার্য পাড়ার কুলীন ব্রাহ্মণ পরিবারটিই হয়ে উঠেছিল নজরুলের বসতবাড়ি, আত্মার আরাম। আর সঙ্গীতসাধক উমাপদ ভট্টাচার্য হয়ে উঠেছিলেন নজরুলের ‘ফেনুদা’। এই ফেনুদাই পরে হয়ে উঠেন নজরুল সঙ্গীতের ‘ভগীরথ’। গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে শুরু করে রেডিয়ো ও পাবলিক অনুষ্ঠানে নজরুল সঙ্গীতের প্রচার ও প্রসার হয়ে উঠল ফেনুদার ধ্যানজ্ঞান। বাংলার ঘরে ঘরে নজরুলের গান ছড়িয়ে দেওয়াকে ব্রত হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন কালীসাধক কুলদাকান্ত ন্যায় চূড়ামণির পুত্র ও মহামহোপাধ্যায় শ্রীরাম শিরোমণির নাতি উমাপদ ভট্টাচার্য। একুশ শতকে মোদী-শাহ-যোগী-বাবুল-শুভেন্দু লালিত সাম্প্রদায়িকতার চাষ-আবাদের শতবর্ষ আগের কথা এটি। উমাপদের উদ্যোগেই লালবাগের নবাব পরিবারের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের দুই কিংবদন্তি গুরু— খেয়াল গানের কাদের বক্স, ঠুংরি গায়ক মঞ্জু সাহেব ও মাস্তান গামা হয়ে উঠেন নজরুলের সঙ্গীতগুরু। তিনি শাস্ত্রীয় মার্গসঙ্গীতের রাগ-রাগিনীর তালিম পান এঁদের কাছ থেকে।
নজরুলের গানের কাটাকুটি, সম্পাদনা, স্বরলিপি প্রণয়ন, গ্রামোফোন কোম্পানিতে রেকর্ডিং, রেডিয়োতে সম্প্রচার, নাটকের সঙ্গীতে সুর ও পাবলিক অনুষ্ঠানে নজরুলের কণ্ঠে সঙ্গীত পরিবেশনের যাবতীয় দায় স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন উমাপদ ভট্টাচার্য। পণ্ডিতদের অনেকের মতে, রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্ষেত্রে দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূমিকার মতোই নজরুলগীতির ক্ষেত্রে উমাপদ ভট্টাচার্যের অবদান। নজরুল সঙ্গীতের প্রচার ও প্রসারে প্রায় ফেনুদার মতোই ভূমিকা পালন করেন নিমতিতা-জগতাই এর নলিনীকান্ত সরকার, বহরমপুরের নিতাই ঘটক ও জগত ঘটক। নজরুলের গানের স্বরলিপিকার নিতাই ঘটকের সঙ্গে একই বাড়িতে নজরুল অনেক দিন বসবাস করেন। কালের গর্ভে বিলীন হওয়ার অনিবার্য পরিণতি থেকে রক্ষা করতে নজরুল সঙ্গীতের প্রথম স্বরলিপি গ্রন্থ ‘সুরমুকুর’ রচনা করেন কবির অগ্রজপ্রতিম, বিপ্লবী নলিনীকান্ত সরকার। বহরমপুরের নলিনাক্ষের প্রতিবেশী নিতাই ঘটক ও জগত ঘটকও ছিলেন নজরুলের গানের অন্যতম স্বরলিপিকার। বহরমপুরের এই ঘটক পরিবারে বসত নজরুলের গানের আসর। কলকাতার ৬০ নম্বর কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে উমাপদ, নজরুল, জগত ঘটক ও মনোরঞ্জন সেনরা ‘বাসন্তী বিদ্যাবীথি’ নামে সঙ্গীত বিদ্যালয় গড়ে তুলেছিলেন। মুর্শিদাবাদের বাউল সঙ্গীতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের পরিচয় মেলে এ জেলার প্রাচীন জনপদ পাঁচথুপির ‘বাণীমন্দির’ নামের গ্রন্থাগারে রক্ষিত খাতায় নজরুলের নিজের হাতে এ বিষয়ে লেখা থেকে।
‘বাসন্তী বিদ্যাবিথী’ নামেরএই সঙ্গীত বিদ্যালয় থেকেই নজরুলের গানের দ্বিতীয় স্বরলিপি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। সেই গ্রন্থের উৎসর্গপত্রে তাঁর ফেনুদাকে উদ্দেশ্য করে কবি লিখেছেন, “কেহ তো জানে না মম গান মম বাণী/ বন্ধু, তোমার কাছে ঋণ কতখানি।/ কত যে হীরক রতন মাণিক দান/ সাজায়েছ নিরাভরণা আমার গানে। অশ্রুমতী সে আমার গানের ভাষা/ তোমার প্রসাদে পেল কত ভালবাসা। তুমি ভগীরথ, আমার সুরধনীরে/ শঙ্খ বাজায়ে এনেছ সিন্ধুতীরে।” রেডিয়োতে তাঁর গানের সুর বিকৃত হওয়ার প্রতিবাদে ও ফেনুদার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে ‘নবশক্তি’ পত্রিকার ১৯২৯ সালের ২৩ অগস্ট সংখ্যায় নজরুল লেখেন, “এক উমাপদ ভট্টাচার্য মহাশয় এবং কচ্চিৎ দু’ একজন গাইয়ে ছাড়া অধিকাংশ ভদ্রলোক বা মহিলাই আমার গান ও সুরকে অসহায় ভেবে, বা একা পেয়ে তার পিণ্ডি এমন ভাবেই চটকান যে, মনে হয় ওর গয়ালাভ ঐখানেই হয়ে গেল।”
১৯২৪ সালে বহরমপুরে কংগ্রেসের সভায় নজরুল বক্তৃতা দেওয়ার পাশাপাশি স্বরচিত গানও গেয়েছেন। তবে কলকাতায় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্মরণসভা- সহ বিভিন্ন সভা-সমিতিতে তাঁর নিজের লেখা গান নিজে গাওয়ার চেয়ে নলিনাক্ষের অনুজ শশাঙ্কশেখর সান্যালকে দিয়ে গাওয়াতেই কবি বেশি পছন্দ করতেন। বিশেষ ঘনিষ্ঠতার কারণে কবি ও সম্পাদক জঙ্গিপুরের শরৎচন্দ্র পণ্ডিত ওরফে দাদা ঠাকুরের শিল্পকীর্তির নানা বৈভব, তাঁর স্যাটায়ার, উইট, শ্লেষ, রূপক, সত্যবাদিতা ও পরিহাসপ্রিয়তা নজরুলের কাব্য সৃষ্টিতে প্রভাব ফেলেছিল বলে অনেক সমালোচক মনে করেন। দাদাঠাকুরকে নজরুল উৎসর্গ করেন তাঁর ‘চন্দ্রবিন্দু’ গ্রন্থটি। উৎসর্গপত্রে দাদাঠাকুরকে নজরুল সম্বোধন করেন, ‘মদ্দাঠাকুর’ বলে। অর্থাৎ মৎ+দা ঠাকুর। এই শ্লেষটির একটি অর্থ আমার দাদাঠাকুর। অন্য অর্থ ‘মদ্দা’, অর্থাৎ পরমপুরুষ।
জগতায়ের নলিনীকান্ত সরকার, বহরমপুরের নলিনাক্ষ সান্যাল, উমাপদ ভট্টাচার্য, নিতাই ঘটক ও বহরমপুরের খাগড়ার বরাট পরিবারের সঙ্গে নজরুলের পরিবারের ছিল অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। কেমন সেই অন্তরঙ্গ সম্পর্ক? শশাঙ্কশেখর সান্যালের বোন অকালে মারা গিয়েছেন। অকালে প্রয়াত সন্তানের শোকসন্তপ্ত পিতা ও মাতাকে সান্ত্বনা দিতে বহরমপুরে এসেছেন নজরুল। সঙ্গে কবির ফেনুদা। সেখানে শোকবিহ্বল নজরুল একটি গান লেখেন। তাতে সুর দেন নজরুলের ফেনুদা। শশাঙ্কবাবু তাঁর ‘অপরিচিত নজরুল’ নিবন্ধে বর্ণনা করেছেন, “মা কাঁদছেন, বাবা কাঁদছেন, আর কেঁদে কেঁদে গেয়ে চলেছেন দাদা (নজরুল) আমার। মধ্যে মধ্যে সুর সংশোধন করছেন ফেনু দাদা।”
বুলবুল মারা যাওয়ার শোক সইতে পারছেন না স্নেহশীল পিতা নজরুল ইসলাম। শোকবিহ্বল নজরুল মাঝে মধ্যেই নিরুদ্দেশ হয়ে যান। তাঁকে খুঁজে ফিরিয়ে আনার দায় পালন করতেন উমাপদ। কলকাতায় অসুস্থ ‘ফেনুদা’কে নিজের গাড়ি ব্যবহার করতে দিয়ে নজরুল ট্রামে-বাসে চলাফেরা করতেন। তাঁর ফেনুদা অসুস্থ। ১৯৩৩ সালে অসুস্থ উমাপদর বড় মেয়ে কমলার বিয়ের আয়োজন সুসম্পন্ন করেন নজরুল। কমলা ও তাঁর ছোট বোন কল্পনা— দু জনেই নজরুলের কাছে গান শিখে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। অল বেঙ্গল মিউজিক কম্পিটিশনে নজরুলের ‘জাগো নারী জাগো বহ্নি শিখা’ গেয়ে কমলা ও নজরুলের ‘মম মদির স্বপনে মম মন ভবনে জাগো চলন্তিকা’ গেয়ে কমলা প্রথম স্থান অধিকার করেন। কমলার মেয়ে স্বাতী মিশ্র সান্যাল রেডিয়োতে নজরুলের ‘ভরিয়া পরাণ’ও ‘কোথা চাঁদ আমার’- এর মতো গান গেয়ে খ্যাতি অর্জন করেন। এই ভাবে তিন প্রজন্ম ধরে উমাপদর পরিবার নজরুলের গানের প্রসার ঘটিয়েছেন। এই কাহিনি আরও অনেক দীর্ঘ।
তাঁর গবেষণামূলক প্রবন্ধ ‘মুর্শিদাবাদ জেলায় নজরুল চরিত্রের উপাদান’-এ লোকসংস্কৃতি গবেষক শক্তিনাথ ঝা যথার্থ অর্থেই লিখেছেন, “মুর্শিদাবাদ জেলা নজরুল সঙ্গীতের যৌবনের উপবন।” তিনি জানিয়েছেন, এ জেলার এক প্রান্তে আছে লোকসঙ্গীত ও কীর্তন এবং অন্য প্রান্তে আছে ভারতীয় মার্গসঙ্গীত ও ইসলামি ঐতিহ্যের নানা গুরুত্বপূর্ণ সংমিশ্রণ। পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র মুসলিম পদকর্তা সৈয়দ মুর্তজা মুর্শিদাবাদ জেলার ভূমিপুত্র। শিয়া সম্প্রদায়ের সুফি ঘরাণার লালবাগের নবাব পরিবারের উদার সংস্কৃতি ও কাশিমবাজারের রাজবাড়ির সঙ্গীতের গণধারায় পুষ্ট হয়েছিল মুর্শিদাবাদ। নজরুলের সাঙ্গীতিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পুষ্ট হয়েছে এই সমন্বয়ের আবহে। তার সঙ্গে মিশেছিল যোগগুরু বরদাচরণ মজুমদারের শাক্তিসাধনার ধারা। রয়েছে গঙ্গা-যমুনার মতো ইসলামি গজল ও শ্যামাসঙ্গীতের ফল্গু প্রবাহ। এই বহুমুখি ও বিচিত্র আবহেই গড়ে উঠেছিল নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনাপ্রবাহ। সমন্বয়ের সেই মিশ্রিত চেতনাই শ্যামা মায়ের রাঙা পা দেখে কবিমনে পুলক জেগেছে, আবার খুশির ঈদের চাঁদ দেখে তিনি উল্লসিত হয়েছেন।
সাহিত্য ও শিল্পকর্মের প্রকৃতি ও ধরনধারন নিয়ে অনেকের মতো শরৎচন্দ্রের সঙ্গেও রবীন্দ্রনাথের বিরোধ ছিল। কবিগুরুর সঙ্গে মতাদর্শগত একই রকম মতদ্বন্দ্ব ছিল বিদ্রোহী কবি নজরুলের। এ ছিল মতবাদিক দ্বন্দ্ব। শব্দ ও ভাষা ব্যবহারেরও ছিল মতপ্রার্থক্য। মত ও পথের বিরোধ। এটা স্বাভাবিক ও সুন্দর। কখনওই সেটা ধর্মীয় সম্প্রদায়গত বিরোধ ছিল না। ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?” ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কাণ্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার!” প্রশ্ন তোলা সাম্যবাদী কবি টুপি-টিকির প্রাণহীন খোলস নিয়েও করেছেন কত মস্করা! সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে যে কবির শাশ্বত জিজ্ঞাসায় আজও জেরবার মানব সভ্যতা, কী ট্রাজেডি! আজও মূঢ়রা তাঁরই সম্প্রায়গত পরিচয় অন্বেষণে পাঁক ঘেঁটে বেড়ায়। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর দিন শোকবিমূঢ় নজরুল তাঁর গুরুদেবকে শ্রদ্ধা জানতে কবিতা লেখেন, গান লেখেন। কবিগুরুর প্রয়াণকালে আকাশবাণীতে স্বরচিত সেই শ্রদ্ধার্ঘ পরিবেশন করতে করতেই নজরুলের চিরতরে বাগরুদ্ধ হয়ে যাওয়ার লক্ষণ প্রথম প্রকট হয়। নিশ্চিত করে কে বলতে পারে, অশীতিপর কবিগুরুর প্রয়াণ, নাকি বুলবুলের অকাল প্রয়াণের আঘাত, নাকি রোগাক্রান্ত প্রমীলার শয্যাগ্রহণ বরদাচরণ মজুমদারের ‘কাজি ভায়া’কে চিরতরে বাকরুদ্ধ করে দেয়?
‘ভুল হয়ে গেছে বিলকুল/ আর সব কিছু ভাগ হয়ে গেছে/ ভাগ হয়নিকো নজরুল’। ১৯৪৯ সালে অন্নদাশঙ্কর রায় এ কথা লেখার পৌনে একশো বছর পরেও সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির তরবারি নজরুলকে ভাগ করার অপচেষ্টায় মশগুল। ‘মানুষ’ কবিতার লেখকের সাংস্কৃতিক চেতনা কতটা ঐসলামিক? আর কতটা অনৈসলামিক? এই কূটতর্কে আজও দুই বাংলার বাঙালিদের অনেকে জেরবার। সম্প্রদায়গত ধর্মের বন্ধন সত্যিই মানুষে মানুষে আত্মিক সম্পর্ক গড়তে পারলে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের জন্ম হত না। বিশ্বে প্রায় আড়াই ডজন ইসলামিক রাষ্ট্রের পৃথক অস্তিত্ব থাকত না। খ্রিস্টান- সহ অন্য ধর্মের ক্ষেত্রেও একই কথা সত্য। ধর্মের বন্ধন আত্মার গভীরে অটুট হলে দরিদ্র মুসলমানকে শোষণ করত না মুসলমান কর্পোরেট মালিক। বিশ্বজুড়ে অসহায় অবস্থায় দিন কাটাত না কোটি কোটি হতদরিদ্র খ্রিস্টান। নিপীড়িত হিন্দুকে পীড়ণ করত না কর্পোরেট হিন্দু মালিক। বিভিন্ন কালে, বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন ধর্ম সময়ের দবি মেনে মানবমুক্তির বার্তা বয়ে আনলেও শোষক ও শোষিতের মধ্যেকার চিরন্তন বৈরিতার আজও অবলুপ্তি ঘটেনি।
নির্বাক কবির নিদারুণ দুর্গতির আভাস মেলে তাঁর বন্ধু, তথা সিপিআই ও পরে সিপিএমের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুজফ্ফর আহমেদের আক্ষেপে। মুজফ্ফর লিখেছেন, “… আমরা ব্যক্তিগত ভাবে, কিম্বা আমাদের পার্টির তরফ হতে এগিয়ে গিয়ে কবির পরিবারের সব দায়িত্ব, অন্তত কিছু কিছু দায়িত্ব, আমাদের হাতে তুলে নিলাম না কেন?” ধর্মীয় সম্প্রদায়গত একাত্মতার দাবি কতটা ঠুনকো তা জানা যায় দারিদ্রপীড়িত নজরুলের কথা থেকেই। ‘সাম্যবাদী’ কবিতার অমর স্রষ্টা নজরুলের বিশেষ ঘনিষ্ঠ ছিলেন শের-ই-বাংলা, তথা অবিভক্ত বাংলার একদা প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক, ওরফে হক সাহেব। ১৯৪২ সালে ১৭ জুলাই প্রায় বাগরুদ্ধ কবি তাঁর বন্ধু জুলফিকার হায়দারকে লিখেছেন, “… সাত মাস ধরে হক সাহেবের কাছে গিয়ে ভিখারির মতো ৫/৬ ঘণ্টা ধরে বসে থেকে ফিরে এসেছি৷ আমি ভাল চিকিৎসা করাতে পারছি না।… কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছে— অতি কষ্টে দু একটা বলতে পারি। বললে যন্ত্রণা হয় সর্বশরীরে। হয়ত কবি ফেরদৌসীর (পারস্যের মহাকাব্য শাহনামার লেখক মহাকবি ফেরদৌসী) মতো ওই টাকা জানাজার দিন পাব। কিন্তু ঐ টাকা নিতে নিষেধ করেছি আমার আত্মীয় স্বজনকে।” প্রবলপ্রতাপ হক সাহেব কিন্তু অতি অসহায় বিদ্রোহী কবির ‘জাতভাই’ হওয়া সত্ত্বেও দুর্দিনে দুখু মিঞা তাঁর কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা পাননি।।
ফজলুল হকের পত্রিকা ‘নবযুগ’-এর সম্পাদক ছিলেন নজরুল। অসুস্থ কবির প্রতি অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হকের এই আচরণে তাই বিস্মিত হতে হয়। বিস্ময়ের কারণ অনেক। ‘লাঙল যার জমি তার’ ও ‘ঘাম যার দাম তার’ স্লোগানের স্রষ্টা হক সাহেব’ বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি অধিগ্রহণ নীতিরও স্রষ্টা। তিনিই কৃষকদের একদা কর মুক্ত করেন ও ‘ঋণ সালিসী বোর্ড’ গঠন করে মহাজনি দেনার ফাঁস থেকে বাংলার অনেক কৃষককে মুক্ত করেন। তিনিই প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষাকে অবৈতনিক করেন। এ রকম বহুবিধ জনহিতকর কর্মের স্রষ্টা নবযুগ সম্পাদকের দ্বারা অসহায় বিদ্রোহী কবি কী ভাবে বঞ্চিত হলেন! সত্যিই এটা বিস্মিত করে। বিরজাসুন্দরীদেবী, উমাপদ, নলিনাক্ষ ও নলিনীকান্তরা কেউই দুখু মিঞার ধর্ম-সম্প্রদায়গত ‘জাতভাই’ ছিলেন না! তাঁরা ছিলেন তাঁর প্রাণের আনন্দ। আত্মার শান্তি। মনের আরাম ও প্রশান্তি। তাঁরা ছিলেন বিদ্রোহী কবির প্রতিভা বিকাশের অকৃত্রিম অবলম্বন। এখানেই নজরুলের সৃষ্ট অমর শ্লোক, ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’ প্রাণ পেয়েছে। জীবন্ত হয়ে উঠেছে। বিমূর্ত বাণী মূ্র্ত হয়ে উঠেছে।
(ঋণঃ মুর্শিদাবাদ ‘বীক্ষণ’-এ প্রকাশিত সংস্কৃতি গবেষক অধ্যাপক শক্তিনাথ ঝায়ের ‘মুর্শিদাবাদ জেলায় নজরুল’, ‘ঝড়’-এ প্রকাশিত পত্রিকা সম্পাদক রবীন বিশ্বাসের ‘আলোকপাত’ ও ‘গণকণ্ঠ’-এ প্রকাশিত সাংবাদিক শান্তনু ঠাকুরের ‘বহরমপুর কারাবাসে নজরুল’ প্রবন্ধসমূহ। অন্য একটি পত্রিকার অনুরোধে ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে এই নিবন্ধটি লেখা হয়েছে।)