কথায় আছে, উঠল বাই তো কটক যাই। বিষয়টা অনেকটা তেমনই। তবে এখানে কটকের পরিবর্তে হবে বারাণসী।
১৮ মার্চ, ২০২২, শুক্রবার
শুক্রবার দোলযাত্রা। শনিবার হোলি ও সবেবরাত। পরের দিন রবিবার। অর্থাৎ, পরপর তিন দিন ছুটি। বৃহস্পতিবার বিকেলে সিদ্ধান্ত নিয়ে শুক্রবার সকালে চার জন সহকর্মী রামচন্দ্র পাল, হেমন্ত মিস্ত্রি, পরিতোষকুমার মণ্ডল ও আমি বেরিয়ে পড়লাম দেওঘরের উদ্দেশ্যে। লক্ষ্য, হাওয়াবদল।
ছোটবেলা থেকে বাংলা সাহিত্য পাঠের মাধ্যমে দেওঘরের সঙ্গে পরিচিতি থাকায় একটু বাড়তি আগ্রহ ছিলই। সকাল ৭টায় বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য দেওঘর। ১৭৪ কিমি গাড়ি চালিয়ে দুপুর ১২টায় পৌঁছলাম ম্যাসেঞ্জর। জলাধার আর পাহাড় দেখে লাঞ্চ সেরে দুমকা রোড দিয়ে পাহাড়ি উচুঁ-নিচু পথে গাড়ি চালিয়ে গেলাম দেওঘর। পথের দু’পাশে অসংখ্য পলাশ গাছ। লাল পলাশ রুক্ষ প্রকৃতিতে এক অপরূপ সৌন্দর্য এনে দিয়েছে। এরপরে গেলাম ত্রিকুট পাহাড়। বেশ মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে খানিকটা সময় কাটিয়ে সরাসরি দেওঘর সৎ সঙ্ঘে পৌঁছলাম সন্ধ্যা ৬টার পরে। বাড়ি থেকে দূরত্ব ২৭৪ কিমি। মন্ত্রপাঠ ও প্রার্থনা চলছিল। রাতে থেকে গেলাম মহেশ গার্ডেন হোটেলে। আমরা তখন তিনটে ঘরে বারো জন। আসলে ত্রিকুট পাহাড়েই দেখা হয়েছিল বাকি আট জনের সঙ্গে। প্রত্যেকেই বিশেষ পরিচিত। খবর নিয়ে ততক্ষণে জেনেছি যে, বেশিরভাগ আশ্রমই বন্ধ। অর্থাৎ, যে আধ্যাত্মিক পরিবেশ ও নির্জনতার টানে ছুটে আসা তা আপাতত আয়ত্তের বাইরে। সুতরাং, দেওঘর সফর কাটছাঁট করে বেরিয়ে পড়তে হবে অন্য কোথাও। অন্য কোনওখানে। ভাবতে ভাবতেই তলিয়ে গেলাম গভীর ঘুমে।
১৯ মার্চ, শনিবার
সকালে ঘুম ভাঙতেই বিছানায় বসেই বারাণসী যাওয়ার প্রস্তাব দিলাম সহকর্মীদের। এক কথায় সবাই রাজি। পরিতোষদা ফোন করলেন বারাণসীতে থাকা ওঁর এক আত্মীয়কে। সেই আত্মীয়ের আন্তরিক আহ্বান এড়িয়ে যেতে পারলাম না। বাড়িতে ফোন করলাম। সম্মতি মিলতেই আর দেরি না করে শুরু হল প্রস্তুতি। কাশী বারাণসীর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম আমরা চার জন। সময় তখন সকাল ১০টা।
হোলির দিন। পথঘাট শুনশান। এ বার আমরা ঝাড়খণ্ড পেরিয়ে বিহারে প্রবেশ করলাম। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি ক্রমশ পাল্টে গেল। বিহারের রাজ্য সড়ক বরাবর চলছি জিটি রোডে পৌঁছনোর লক্ষ্যে। রাস্তায় হোলির উন্মাদনা। লক্ষ্য করলাম, উল্টো দিক থেকে আসা গাড়িগুলোতে (যদিও গাড়ির সংখ্যা খুব কম) গোবরের প্রলেপ। বুঝতে পারলাম, আমার সাধের ‘ওয়াগন-আর’ গাড়ির ও একই অবস্থা হতে চলেছে। হঠাৎই একটি বাড়ির ছাদ থেকে উড়ে এলো বালতিভর্তি গোবর জল। একটু এগিয়ে দেখলাম, রাস্তার পাশে ছেলেদের জটলা থেকেও গানইর উইন্ড স্ক্রিন লক্ষ্য করে এক বালতি গোবর জল ছুড়ে দিল কেউ। গতি সামান্য বাড়িয়ে নিলাম। ফলে গাড়ির ডান দিকে গোবর লেপ্টে গেলেও উইন্ড স্ক্রিনে সবটা লাগেনি। ‘তবে এ বারে ওই মিশ্রণের ঘনত্ব বেশি ছিল’, বলে উঠলো রাম।
ঘনত্ব বলতেই হেমন্ত মনে করিয়ে দিল আমাদের বর্তমান প্রধান শিক্ষক রজতকুমার সরকার মহাশয়ের কথা। করিমপুরের দুটো মিষ্টির দোকানের মিষ্টির কোয়ালিটি নিয়ে আলোচনায় বার বার তিনি জানিয়েছেন যে, দুটো দোকানের মিষ্টির পার্থক্য শুধু মিষ্টির রসের ঘনত্বে। অবশ্য ওঁর ভাষায়, ‘ডেনসিটি’। পরিতোষদা অবশ্য জানালেন, ‘এখন ডেনসিটি নিয়ে আলোচনার সময় নয়। এমনিতেই গুগল ম্যাপ কাজ করছে না মাঝে মাঝে। ভালো ভাবে ফিরলে তখন গোবরের ডেনসিটি মাপা যাবে।“
ইতিমধ্যে পরিতোষদা মাস্কটা মুখে ভালো করে লাগিয়ে নিল। বুঝলাম না, কাচবন্ধ গাড়ির শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে বসে গোবর হানা প্রতিরোধের এটা কোনও পদ্ধতি কিনা। এমনিতেই উনি নিচু স্বরে কথা বলে থাকেন। এ বারে যে ভয় পেয়ে কী সব বললেন, শুনতে পেলাম না কেউই। কিছুক্ষণের মধ্যেই আরও এক দফা আক্রমণ। এ বারে গাড়ির ছাদে পড়লো কাপড়ের ব্যাগভর্তি কাঁচা গোবর। তবে বলে রাখি, ভিন রাজ্যে এমন আপ্যায়নে প্রাপ্তবয়স্কদের সক্রিয় ভূমিকা ছিল বেশ চোখে পড়ার মতো। অবশেষে গয়াগামী রাস্তা পেলাম। পথে একটা জলের কল পেলাম। কয়েক বোতল জল ঢেলে উইন্ড স্ক্রিনকে কাজ চালানোর মতো পরিষ্কার করে নিলাম
গয়া ও বুদ্ধ গয়া পেরিয়ে জিটি রোডে পৌঁছলাম। কিছুটা এগিয়ে শের ই বিহার হোটেলে জমিয়ে লাঞ্চ সারলাম। তবে ঘড়িতে তখন বিকেল ৪টে। এ বারে ছ’লেনের জিটি রোড দিয়ে চাপমুক্ত মনে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চললাম বারাণসীর দিকে। ততক্ষণে সহকর্মী পরিতোষদা ফর্মে ফিরেছেন। মাস্ক খুলেছেন। বেশ কথাও বলছেন। আসলে, গোবর ক্ষেপণাস্ত্রের আক্রমণে তিনিও কিছুটা ঘেঁটে গিয়েছিলেন।
আমাদের হোস্ট অর্থাৎ পরিতোষদার ভাইপো কুমারেশ (যিনি অবশ্য পরে আমাদেরই ভাইপো হয়ে উঠলেন) পথ নির্দেশ দিতে থাকলেন আর আমরা সেই মতো এগিয়ে চললাম বারাণসী শহরের মধ্যে দিয়ে। কান্ট স্টেশনের রাস্তায়, চৌকিঘাটের দিকে এগিয়ে কুমারেশের দেখা পেলাম। অবশেষে পৌঁছলাম নাটুমলি। সময় রাত্রি পৌনে ৯টা। ৪৮১ কিমি পথ আজ ড্রাইভ করেছি। আর বাড়ি থেকে এখন প্রায় সাতশো কিমি দূরে অবস্থান করছি।
বারাণসী শহর। মানব সভ্যতার ইতিহাসে অন্যতম প্রাচীনতম জনপদ। ঋগ্বেদে, স্কন্দ পুরাণে এবং মহাভারতে উল্লেখিত দেবাদিদেব মহাদেবের শহর এই কাশী বারাণসী। শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি, সাহিত্য ও সঙ্গীতের প্রাচীনতম ও ঐতিহ্যমণ্ডিত পীঠস্থান। কবীর, রবিদাসের মতো ভক্তিবাদী ও গুরু নানকের মতো ধর্মপ্রচারক এখানে ছুটে এসেছেন। জৈনতীর্থঙ্কর পার্শ্ব বারাণসীর বাসিন্দা ছিলেন। প্রাচীন ভারতের বিশিষ্ট শল্য চিকিৎসক সুশ্রুত বারাণসীতে বাস করতেন। ফা হিয়েন ও হিউ এন সাং-এর মতো প্রথিতযশা পর্যটক বারাণসী ভ্রমণ করেছেন। তুলসি দাসের মতো প্রতিভাবান ব্যক্তি এই শহরে বসেই সৃষ্টি করেছেন রামচরিত মানস। পৃথিবীর অসংখ্য দেশের মানুষ এখনও বারাণসী ভ্রমণ করে থাকেন। অতীতে বার বার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েও প্রতিবারই স্বমহিমায় মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে এ শহর। বেনারসি শাড়ি, হাতির দাঁতের কারুকাজ ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ঘরানা এ শহরের একান্তই নিজস্ব। সানাইগুরু ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান ও সেতার সম্রাট পণ্ডিত রবি শঙ্করজী এ শহরে বাস করেছেন। আমেরিকান সাহিত্যিক মার্ক টোয়ায়েনও এই শহরের টান অস্বীকার করতে পারেননি। অসংখ্য বাঙালির বার্ধক্যের পীঠস্থান এই কাশী বারাণসী। এখনকার মনিকর্ণিকা ঘাট হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে সবচেয়ে প্রার্থিত অন্তিম গন্তব্য। হিন্দু ধর্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান এই কাশী বারাণসী। সন্নিকটে সারনাথ। বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পীঠস্থান। স্বভাবতই পর্যটকমাত্রই রোমাঞ্চিত ও শিহরিত।
২০ মার্চ, রবিবার
আমাদের গাইড, ভাইপো কুমারেশ। তার দেখানো পথেই আমরা পৌঁছলাম রাজেন্দ্র ঘাটে। কবি বলেছেন, ‘ভাগীরথীর পশ্চিম কূল, বারাণসী সমতুল।’ আর আমরা পৌঁছে গিয়েছি খোদ বারাণসীতেই। জিম করবেটের পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছিল যে, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস গঙ্গার পশ্চিম তীরের জল পূর্ব দিকের জলের চাইতে বেশি পবিত্র এবং দেশের দূরবর্তী স্থানে বারাণসীর গঙ্গার জল মহামূল্যবান।
যাইহোক, প্রত্যেকে প্রায় ডজন খানেক করে ডুব দিয়ে গঙ্গা স্নান সেরে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে বিশ্বনাথ মন্দিরে পুজো দিলাম। পাশেই পুণের রাজার প্রতিষ্ঠিত অন্নপূর্ণা মন্দির দর্শন করলাম। বিশ্বনাথ মন্দির থেকে তিন ফুট দূরত্বে আওরঙ্গজেব প্রতিষ্ঠিত মসজিদটি। সোনায় মোড়া বিশ্বনাথ মন্দির ঘিরে রয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনীর নিরাপত্তা। ওয়াচ টাওয়ার ও ড্রোনের মাধ্যমে নজরদারি ছাড়াও রয়েছে প্রশিক্ষিত কম্যান্ডো বাহিনীর প্রহরা। ঈশ্বর এখানে কড়া নিরাপত্তা বলয়ে। সম্প্রতি মন্দির ও সংলগ্ন এলাকায় ব্যয়বহুল সংস্কারের কাজ হয়েছে।
আবার কুমারেশের বাড়ি ঢুকলাম। সময় সকাল ১০টা। ততক্ষণে পথে, গঙ্গার ঘাটগুলোতে, কাশী, বারাণসীর বিখ্যাত গলিগুলোতে সর্বত্র মানুষের ভিড়ে পরিপূর্ণ। বেলা ১১টা নাগাদ গাড়ি নিয়ে আমরা পাঁচ জন বেরিয়ে পড়লাম সারনাথ ভ্রমণে। বারাণসী থেকে প্রায় সাত-আট কিমি দূরে সারনাথ। প্রথমেই দর্শন করলাম সেই স্থান যেখানে গৌতম বুদ্ধ শিষ্যদের দীক্ষা দান করেছেন যা ইতিহাসে বুদ্ধের ধর্মচক্র প্রবর্তন নামে খ্যাত। এরপরেই সারনাথের সেই বিখ্যাত স্তূপ দর্শন করলাম। একটু বিশ্রাম নিয়েই এ বারে সারনাথ মিউজিয়ামে ঢুকলাম। সামনেই রয়েছে অশোক স্তম্ভ। এই অশোক স্তম্ভটিই আমাদের দেশের জাতীয় প্রতীক। চারটি সিংহের মধ্যে ছবিতে তিনটে দেখা যায়। চতুর্থ সিংহটি আড়ালে থাকে। এখানে এসে চতুর্থ সিংহটিও দর্শন করা গেলো। বেশ খানিকটা সময় ব্যয় করলাম এখানে। ছোটোবেলা থেকেই এই অশোক স্তম্ভ সম্পর্কে সবারই তাত্ত্বিক জ্ঞান থাকে। আর এখানে এসে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জ্ঞান মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। অশোক স্তম্ভের বৈশিষ্ট্যগুলি সম্পর্কে ও তার গঠনগত দিকের মধ্যে যে রূপকগুলো ব্যবহৃত হয়েছে সে সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করা গেল। এরপরেই রয়েছে অশোকচক্র, পিলার, ছাতা ইত্যাদি। অসাধারণ শৈল্পিক কারুকাজ খচিত অসংখ্য মূর্তি ও তৎকালীন স্থাপত্যশৈলীর ও ভাস্কর্যের অসংখ্য অনন্য এই বিপুল শিল্প সম্ভার পরিদর্শনের পরে বেশ তৃপ্ত মনে হচ্ছিল। শিক্ষক হিসেবে বারবার মনে পড়ছিল ছাত্র, ছাত্রীদের কথা যাদের জন্য একটি অসাধারণ শিক্ষামূলক ভ্রমণের স্থান এটি। ইতিহাসের তাত্ত্বিক জ্ঞান অর্জন করে এখানে এসে স্বচক্ষে ইতিহাসের এই উপাদানগুলো দেখলে সেই জ্ঞান চিরকাল মনের মণিকোঠায় থেকে যাবে।
বাইরে তখন চড়া রোদ। এ বারে আমরা প্রবেশ করলাম সারনাথ এলাকায় প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কার্যের ফলে যে স্থাপত্য আবিষ্কৃত হয়েছে সেখানে। সম্রাট অশোকের সময়ের পিলার ও শিলালিপিগুলো বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। পরবর্তী গন্তব্য কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় বা বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি। এশিয়ার সর্ববৃহৎ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে যাওয়ার পথের পাশে একটি জরুরি কাজ সেরে নিলাম। কাজটা আর কিছুই নয়, আমাদের বাহনটিকে ভালো করে স্নান করানো। আসলে বিহার থেকে বয়ে আনা গোবরের প্রলেপ তখনও বাহনের গায়ে লেপ্টে ছিল। স্নান-পর্ব শেষ করে চললাম কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় ও নতুন বিশ্বনাথ মন্দির দর্শনে। গাছপালা ঘেরা অসাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস দেখে মন ভরে গেল। পরিতোষদার একটু বেশি ভালো লাগছিল। কারণ, এখানেই তিনি MCA তে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। যদিও তিনি অন্যত্র পড়াশোনা করেছেন। পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য বিংশ শতাব্দীর প্রথমে এই নতুন মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করিয়েছিলেন। এরপরেই আমাদের লক্ষ্য, সন্ধ্যার গঙ্গারতি দর্শন। নবনির্মিত আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিংয়ে গাড়ি রেখে এ বারে আমরা পাঁচজন শহরের ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে চললাম দশাশ্বমেধ ঘাটের দিকে। এই সময়ে ভালো করে টিফিন করে নিলাম। পরিতোষদা ইডলি খেলেও আমরা খেলাম ধোসা।
বারাণসীতে গঙ্গার চুরাশিটি ঘাট রয়েছে। প্রত্যেকটি ঘাটের নিজস্ব ঐতিহ্য রয়েছে। আমরা পৌঁছলাম দশাশ্বমেধ ঘাটে। প্রচলিত বিশ্বাস, এখানে স্নান করলে নাকি দশটি অশ্বমেধ যজ্ঞের সমান পূণ্য অর্জিত হয়। গঙ্গাতীরে বিকেলের শোভা অতুলনীয়। রয়েছে অসংখ্য পর্যটকের ভিড়। চলছে আরতি শুরুর প্রস্তুতি। প্রচুর নৌকা ভেসে বেড়াচ্ছে গঙ্গায়। কয়েকশো ছোট বড় নৌকা পর্যটকের অপেক্ষায় নোঙর করা রয়েছে। দরাদরি চলছে। আমরাও নৌকা ভাড়া নিলাম। গঙ্গায় নৌকা চেপে গঙ্গারতি দর্শন করলাম। চোখ জুড়িয়ে গেল। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। আলো ঝলমলে এক মায়াবী পরিবেশ। কাঁসর-ঘণ্টার শব্দ ও আরতির মন্ত্র মিলেমিশে এক অসাধারণ পবিত্রতা এনে দিয়েছে। আসলে এ দৃশ্য এখানে প্রতিদিনের। ততক্ষণে গঙ্গার শীতল হাওয়াতে সারাদিনের ক্লান্তি উধাও। গোটা গঙ্গা জুড়ে শুধু নৌকা আর নৌকা। নদী বক্ষে ঘুরে দেখলাম রাজেন্দ্র ঘাট, মান ঘাট, শীতলা ঘাট, মনিকর্ণিকা ঘাট, হরিশচন্দ্র ঘাট ইত্যাদি। বারাণসী ভ্রমণ পরিপূর্ণতা লাভ করল।
গঙ্গার ঘাট থেকে পার্কিংয়ের দিকে যাওয়ার সময় মনে হচ্ছিল, এখানকার রাস্তা যেন দুর্গাপুজোর আগের সপ্তাহের কলকাতার লিন্ডসে স্ট্রিট। অবশ্য এখানে বছরভর পুজো। ফলে পথও বছরভর জনারণ্য। পার্কিং থেকে গাড়ি বের করে ফুরফুরে মেজাজে ফিরে এলাম ভাইপোর বাসস্থানে। বারাণসী সফরে ডাবের জল, শীতল পানীয় এবং কম মশলাযুক্ত ঘরোয়া খাবার আমাদের বাড়তি এনার্জি জুগিয়েছিল। ভাইপো কুমারেশ ও তার স্ত্রীর আতিথেয়তার কোনও তুলনা হয় না। আরামদায়ক ও নিরাপদ আশ্রয়, সুস্বাদু খাবার ও যথার্থ গাইডের মতো সর্বক্ষণের সঙ্গী হওয়া— এ সব না পেলে এত কম সময়ে এত ভালো ভ্রমণ সম্ভব হতো না। তাদের আন্তরিক ব্যবহার আমাদের সবাইকে মুগ্ধ করেছে। এ বারে ফেরার পালা।
২১ মার্চ, সোমবার
স্নান সেরে বারাণসীকে বিদায় জানিয়ে সকাল ৭টায় বেরিয়ে পড়লাম। পথে রামনগর। সেখানে রয়েছে ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর পৈতৃক নিবাস ও কাশীর মহারাজার কেল্লা বা দুর্গ। সেখানে অল্প সময় কাটিয়ে বেরিয়ে পড়লাম বাড়ির পথে। জিটি রোড দিয়ে আমাদের গাড়ি ছুটে চলেছে। পথে একবার লাঞ্চ ব্রেক। তারপরে ফের ছুটে চলা। দুপুর ৩টের দিকে একটু ক্লান্ত মনে হল। ঝাড়খণ্ডে জিটি রোডের পাশে এক গাছতলায় গাড়ি থামিয়ে মাত্র পাঁচ-ছয় মিনিট ঘুমিয়ে নিলাম। আর তারপরেই চোখে মুখে জল দিয়ে, চা খেয়ে অনেকটা সতেজ হয়ে উঠলাম। পশ্চিমবঙ্গ তখনও দেড়শো কিমি দূরে। আবার ছুটে চলা।
ঝাড়খণ্ডের মধ্যে দিয়ে যত এগিয়ে চলেছি ততই পথের শোভা যেন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিন দিকে পাহাড় ঘেরা উচুঁ-নিচু ছ’লেনের কলকাতাগামী জিটি রোড, দু’পাশে অসংখ্য পলাশ গাছের সারি আর অসংখ্য প্রস্ফুটিত পলাশ দেখে মনে হচ্ছিল যেন আরও একটি দর্শনীয় স্থানে এসে পড়েছি। আসলে কয়েকদিন আগেও পলাশ ফুল দেখতে পুরুলিয়া যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। আমাদের সে ইচ্ছেও পূর্ণ হলো। সন্ধ্যায় পৌঁছলাম আসানসোল। হোটেল পার্বতী ইন্টারন্যাশনালে আরামদায়ক বিছানায় লম্বা একটা ঘুম।
২২ মার্চ, মঙ্গলবার
এক ঘুমেই সকাল। স্নান ও ব্রেকফাস্ট সেরে হোটেল পার্বতী ইন্টারন্যাশনাল থেকে বেরোলাম সকাল ৯টায়। রানীগঞ্জ পৌঁছে ছ’লেনের জিটি রোড দিয়ে গাড়ি চালানোর মোহ ত্যাগ করে জামুরিয়ার পাশের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চললাম মামা ভাগ্নে পাহাড় দেখতে। অবশ্য ইতিমধ্যে কয়লা খনি দর্শনও হয়েছে। এরপরে চললাম বক্রেশ্বর। উষ্ণ প্রস্রবণ দর্শন ও মন্দির পরিক্রমা সেরে এ বারে এগোলাম সিউড়ির দিকে। সিউড়ি, সাঁইথিয়া হয়ে আঁদিতে সেই মিষ্টির দোকানে আবারও আমরা উপস্থিত। দেওঘর যাওয়ার সময় এখানেই ডালপুরি, মিষ্টি সহযোগে ব্রেকফাস্ট সেরেছিলাম। আসলে মিষ্টান্নপ্রিয় আমাদের চার জনেরই গত চার দিন ভালো মিষ্টি জোটেনি মোটেই। এরপরে কান্দি পার করে এসে অনেকদিনের পরিচিত দেব হোটেলে লাঞ্চ সারলাম। এ পথে এলে প্রতিবারই এখানে খাওয়া আমার কাছে একটা বাড়তি আকর্ষণ। হোটেলটির প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই মাঝে মাঝে এখানে থেমেছি। হোটেল মালিকের সঙ্গে একটা পরিচিতি গড়ে উঠেছে। দেখলাম, করোনা পর্বের দীর্ঘ বিরতির পরেও পরিচিতি একই রকম আছে। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় বাড়ি ফিরলাম।
পুনশ্চ:- গত কয়েক দিনের পর্যবেক্ষণ যা না লিখলেই নয়
১) সহকর্মী হেমন্ত হিন্দিভাষী অঞ্চলে যেন জ্বলে উঠল তার একান্ত নিজস্ব তথা ব্যাকরণবহির্ভূত হিন্দি বাচনভঙ্গির মাধ্যমে। স্মার্টনেসের দিক দিয়ে এখানে সে রামকেও পিছনে ফেলে দিয়েছে।
২) রাম ও হেমন্ত জুটি যে কোনও সফরে অপ্রতিরোধ্য। বাকিদের কাজ ও উদ্বেগ কোনও কিছুই থাকে না।
৩) আমাদের ‘অনলাইন দাদা’ পরিতোষবাবুর ভ্রমণ পরিপূর্ণতা লাভ করে শপিং মলে কেনাকাটা করলে ও মাল্টিপ্লেক্সে অন্তত একটি সিনেমা দেখলে। এ বারে সে সুযোগ মেলেনি। ফলে সেই হিসেবে পরিতোষদার ভ্রমণ অসম্পূর্ণ। প্রসঙ্গত, ফিরে আসার পরে তিনি কৃষ্ণনগর মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা দেখে এসেছেন।
৪) আমার সম্পর্কে কী আর বলব? দীর্ঘ ১৫৫০ কিমি গাড়ি ড্রাইভ করে আমিও আনন্দিত ও আত্মবিশ্বাসী। বুঝতে পারলাম, গাড়ি চালানোটা আমার কাছে বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে।