দীপক সাহা

হাত ছেড়ে ঘাসফুলে লাফ বাম সমর্থিত কংগ্রেস বিধায়ক বাইরন বিশ্বাসের। তোলপাড় বঙ্গ রাজনীতি। গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূলের একঝাঁক নেতা বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন৷ বিজেপি হেরে যাওয়ায় মুকুল রায়, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, অর্জুন সিং, সব্যসাচী দত্তের মতো নেতারা আবার ঘাসফুল শিবিরে ফিরে এসেছেন৷ বাবুলেরও এখন প্রিয় বিচরণ ক্ষেত্র পদ্মকানন নয়, ঘাসবন। আর এই ভোলবদলের চিত্রপটে শেষ সংযোজন বাইরন বিশ্বাস। ‘মিরজাফর’, ‘বিশ্বাসঘাতক’, ‘গদ্দার’, ‘ধান্দাবাজ’, ‘মেরুদণ্ডহীন’…। অভিধান ও অভিধানের বাইরে যত রকম বিশেষণ আছে সবই এই ‘গিরগিটি প্রজাতির রাজনীতির কারবারিদের’ দিকে ধেয়ে আসে। কিন্তু জনগণের সেবার দোহাই দিয়ে তাঁরা নিজেদের স্বপক্ষে যুক্তি খাড়া করতে সিদ্ধহস্ত। ক্লাব-ফুটবলে জার্সি বদলের মতো রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীরা দলবদল করছেন। এই প্রসঙ্গে নচিকেতার গানটি মনে পড়ে, ‘আজকে যিনি দক্ষিণেতে কালকে তিনি বামের/আজকে যিনি তেরঙ্গাতে কাল ভক্ত রামের’। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে।
ভারতের রাজনীতিতে আয়ারাম-গয়ারাম কথাটা বেশ চালু৷ রাজনীতিতে দলবদল তো আর নতুন কথা নয়। নেতা-নেত্রীরা দল গড়েছেন। দল ছেড়েছেন। অন্য দলে গিয়েছেন। এমন অজস্র উদাহরণ রয়েছে বঙ্গ তথা জাতীয় রাজনীতির পরতে পরতে। কিন্তু অতীতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, দল ছাড়া বা দল গড়ার নেপথ্যে মূলত মতাদর্শগত সংঘাতই প্রাধান্য পেয়েছিল। কিন্তু বিগত কমবেশি এক দশক কাল ধরে রাজনীতিতে দলবদলের হাত ধরে যেভাবে ক্ষমতা দখলের প্রদর্শনী বারংবার চিত্রায়িত হয়ে চলেছে, তাতে রাজনৈতিক মূল্যবোধের চরমতম দেউলিয়াপনাকেই প্রকট করে তুলেছে।
ভোগসর্বস্ব সমাজে নীতিহীন রাজনীতিরই রমরমা। সুযোগসন্ধানী রাজনীতির ব্যবসায়ীদের কাছে মতাদর্শের থেকে নিজের স্বার্থই বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে৷ রাজনীতি হয়ে উঠেছে পেশা৷ দলবদলুদের কাছে রাজনীতি হল মোটা অর্থের আকর্ষণ, ব্যক্তিগত শ্রীবৃদ্ধি, মন্ত্রিত্ব, ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব কায়েমের উচ্চাকাঙ্খা। আসলে রাজনীতিতে যেমন ‘শেষ’ বলে কিছু নেই, রাজনীতির কারবারিদেরও ‘শেষ ঠিকানা’ বলতেও কিছু নেই। চুলোয় যাক মানুষ এবং তাঁদের দেওয়া নির্বাচনী রায়! বৈদ্যুতিন মাধ্যমের ক্যামেরা তাক করলে না হয় তোতাপাখির মতো সেই অমোঘ বুলি আওড়ে নেওয়া যাবে … “মানুষের জন্য কাজ করতে চাই, তাই এ দলে এলাম।’’
রাজনীতি শব্দের অর্থ নীতির রাজা বা শ্রেষ্ঠ নীতি, যার দ্বারা রাজ্য বা রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। সাধারণ মানুষকে সেবা করায় রাজনীতিবিদদের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। কিন্তু সেটা হয়ে দাঁড়িয়েছে স্রেফ কথার কথা। বর্তমানে রাজনীতির সহজ সংজ্ঞা হচ্ছে সাধারণ মানুষের সেবা নয়, নিজেদের আখের গুছোনোই মুখ্য। বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলেরই নীতি, নৈতিকতা, মতাদর্শ, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ভোগসর্বস্ব সমাজে বিলুপ্তপ্রায়। আজ তাই নীতিহীন রাজনীতিরই রমরমা। এই সব নেতা-কর্মীরা হিসেব কষেন কোন দলে গেলে লাভ কত? কার পালে হাওয়া বেশি? কোন দল ক্ষমতায়? কোথায় গেলে পলিটিক্যাল কেরিয়ার সুরক্ষিত হবে? ব্যক্তিগত লাভ, সুবিধাবাদী রাজনীতির চর্চা, দুর্নীতির পরে শাস্তির ভয়, দলীয় টিকিট না পাওয়া, এগুলিই দলত্যাগের কারণ। কোনও আদর্শের টানে তাঁরা দলবদল করেন না। রাজনৈতিক দলগুলিও ক্ষমতা দখলের রাজনীতি করে। কাকে বা কাদের নিলে ক্ষমতা দখল করতে পারবে এই হিসাব-নিকেশ করেই দলত্যাগকে মদত দেন তাঁরা।
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, কোনও জনপ্রতিনিধি একটি দলের টিকিটে জেতার পরে যখন অন্য দলে যাচ্ছেন, সেক্ষেত্রে সাংসদ বা বিধায়ক পদ ছাড়ার নৈতিকতা কেন দেখাচ্ছেন না? কেউ যদি দল বদলাতে চান, সেক্ষেত্রে সংসদ বা বিধানসভার সদস্যপদ ছেড়ে দেওয়া উচিত৷ এমনটাই মত অনেক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞের। অভিযোগ, আইন থাকলেও দলবদলের অভিযোগের নিষ্পত্তি হতে অনেক সময় লাগে অথবা রাজনৈতিক প্রভাবে সুবিচার হয় না৷ সেক্ষেত্রে সংবিধানে দলত্যাগ বিরোধী আইন থাকলেও সেই আইনের নানা ফাঁক গলে দলত্যাগ চলছেই। অনৈতিক দলবদলকে বন্ধ করার মতো শক্তিশালী আইন নেই৷
ফলে রাজনীতির কারবারিরা নীতিহীন রাজনীতির মধ্যে দিয়ে, ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতির হিসাবের মধ্যে দিয়ে জনগণের আস্থা-বিশ্বাসকে যেমন আঘাত করছেন তেমনই রাজনীতি সম্পর্কে জনগণের মনে অশ্রদ্ধা গড়ে তুলছেন। ভোট রাজনীতি কার্যত একটা প্রহসনে পরিণত হচ্ছে। এই হীন রাজনীতিতে জনস্বার্থেরই সবচেয়ে ক্ষতি। মজার ব্যাপার, জনতার ভোটে একবার নির্বাচিত হয়ে গেলে জনপ্রতিনিধিদের কর্মকাণ্ডের উপর স্থবির জনতার আর কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকে না। সেই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি তাঁর নির্বাচকদের বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করেই এবং তাঁর বর্তমান জনপ্রতিনিধিত্ব থেকে ইস্তফা না দিয়েই (দু-একটি ব্যাতিক্রম ছাড়া) নিজ প্রয়োজন ও ইচ্ছানুসারে হইহই করে অন্য যে কোনও দলে অনায়াসে ভিড়ে যেতে পারেন। যে রাজনৈতিক দলের আদ্যোপান্ত বিরোধিতা করে তিনি নির্বাচিত হয়েছেন, এমনকি সেই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলে ভিড়তেও কোথাও এতটুকুও মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা হয় না। সবচেয়ে চমকপ্রদ ঘটনাটা হল, এত কিছু জেনে-বুঝে নেওয়ার পরেও আমজনতা কিন্তু আবার সেই মানুষগুলোকেই ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবেন, যাঁরা জনতার রায়কে তাচ্ছিল্য করেই নিজ ইচ্ছানুসারে ক্রমাগত দলবদল করে এসেছেন!
রাজনীতি এখন একটা বাজারে পরিণত হয়েছে৷ অর্থাৎ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মানুষের লেনদেনের সম্পর্ক৷ ভোট দেওয়ার সময় মানুষ দেখছে, সে কী ভাবে এই দল বা ব্যক্তির থেকে লাভবান হয়েছে৷ সেই প্রার্থী দল বদলেছেন কিনা বা কতটা আদর্শ মেনে চলেন, সেটা বিবেচনায় থাকছে না৷ মূল্যবোধের রাজনীতির ঝোঁক কমছে৷ বৃহত্তর আর্থ-সামাজিক সঙ্কটের তুলনায় নিজেদের চাওয়া-পাওয়ার ভিত্তিতে ভোট দিতে বেশি পছন্দ করছেন ভোটাররা৷ এর সঙ্গে গণচেতনার যোগ আছে কি? ১৯৫২ সালে ভারতে প্রথম সাধারণ নির্বাচনের সময় মাত্র ১২ শতাংশ মানুষ সাক্ষর ছিল৷ এখন সাক্ষরতার হার অনেক বেড়েছে৷ কিন্তু শিক্ষিতের হার বাড়েনি, চেতনা তৈরি হয়নি। আমাদের দেশে জনশিক্ষার যে হাল, তাতে মানুষ সব সময় নিজের সুদূরপ্রসারী ভালো-মন্দ বিচার করতে পারে না৷ তাই অপরাধীরা ভোটে জিতে যায়৷ সেটা শুধু গায়ের জোরে নয়, জয়ের পিছনে জনসমর্থনও থাকে৷
কোনও নির্বাচিত নেতা তাঁর নিজের স্বার্থে ক্ষমতাসীন দলের দিকে ঝুঁকে পড়লে সেটা গণতন্ত্রের পক্ষে স্বাস্থ্যকর নয়৷ ক্ষমতা ও অর্থ যদি রাজনীতির মূলধারায় বেশি প্রভাবশালী হয়ে ওঠে, তা গণতন্ত্রের পক্ষে ইতিবাচক নয়। আমাদের গণতন্ত্র দলনির্ভর৷ যদি এই ব্যবস্থা আদর্শশূন্য হয়ে পড়ে তা হলে গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা কমে যাবে৷ পুরো ব্যবস্থা ক্ষমতাবানদের কুক্ষিগত হয়ে যাবে৷ এই গণতন্ত্র দেশের বঞ্চিত মানুষের পক্ষে আদৌ স্বার্থবাহী হবে না। পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করেন, এই পদ্ধতিতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ক্ষয় হলে একনায়কতন্ত্র বা সামরিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অনুকূল পরিবেশ তৈরি হবে৷
এখনকার রাজনীতিকদের ‘পোস্ট আইডিওলজি পলিটিশিয়ান’ বলা হয়৷ অর্থাৎ আদর্শ-উত্তর যুগের রাজনীতিক৷ এই সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে আদর্শগত পার্থক্য ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। দলের থেকে ব্যক্তি বড় হয়ে যাচ্ছে৷  নেতারা দল পরিবর্তন করার পরে আবার ভোটে দাঁড়িয়ে অন্য দলের টিকিটে নির্বাচিত হচ্ছেন। সাধারণ মানুষ দলত্যাগীদের অনেক ক্ষেত্রেই প্রত্যাখ্যান করছে না৷ তাহলে কি সমাজের চোখে দলবদল আর কোনও গর্হিত কাজ নয়? তাহলে কি রাজনীতিতে আদর্শ ও বিশ্বাসের গুরুত্ব কমে যাচ্ছে? তাহলে রাজ্য তথা দেশ জুড়ে রাজনৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই গুণোত্তর অগ্রগতি কি এভাবে চলতেই থাকবে? উত্তরে দিশা আমাদেরই খুঁজতে হবে।
রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তি এবং রাজনৈতিক মূল্যবোধের অস্তিত্ব এখন গভীর সঙ্কটে। শুধু দলত্যাগ বিরোধী আইনের দ্বারা এই সঙ্কটের সমাধান সম্ভব নয়। দেশের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে সাধারণ মানুষকে রাজনৈতিকভাবে আরও সুশিক্ষিত ও সচেতন  হওয়া জরুরি। নতুবা গণতন্ত্রের সুফল সমাজের প্রান্তিকস্তর পর্যন্ত অধরাই থাকবে। তাই দলমত নির্বিশেষে জনগণকেই বলিষ্ঠ ভাবে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই নীতিহীন, সুবিধাবাদী রাজনীতি পরাস্ত হতে পারে। নইলে দেশে তো বটেই, এ বঙ্গেও এমন ভোলবদলের নাটক চলতেই থাকবে।

(প্রবন্ধের বক্তব্য লেখকের নিজস্ব)
এই বিভাগে লেখা পাঠান sadakalonewz@gmail.com— এই মেলে