সন্দীপন মজুমদার
প্রথম দৃশ্য: এক ভদ্রলোক সিনেমা পরিচালনায় প্রায় চোদ্দো বছর কাটিয়ে দেওয়ার পরে এই প্রথম একটি ছবিতে একই সঙ্গে শৈল্পিক এবং বাণিজ্যিক সাফল্য পেয়েছেন। মুম্বইয়ের (তখনকার বোম্বে) বেশ কয়েকজন নামী প্রযোজক তাঁর কাছে ঝুলোঝুলি করছেন এরকম আরও ছবি বানানোর জন্য। তিনি তাঁদের প্রস্তাব দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করছেন। আগের ছবি সাফল্য পেয়েছে বলে একই ছকে পরের ছবি তিনি বানাতে চান না। নিজের কাজেও সেই প্রমাণ রাখলেন। এরপরই যে ছবিটি বানালেন সেটি রাজনৈতিক আবহে, পরীক্ষামূলক প্রচেষ্টায়, সামাজিক সম্পৃক্তিতে অনেকটাই আলাদা গোত্রের। আজকের কোনও বাঙালি পরিচালক হলে হয়তো প্রথম সফল ছবিটির সিকোয়েল ১, ২ নেমে যেত।
দ্বিতীয় দৃশ্য: ওই দীর্ঘদেহী ভদ্রলোক পুণে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে ভাবী চলচ্চিত্র পরিচালকদের সামনে বক্তব্য রাখছেন। বলছেন, ‘‘নবীন বন্ধুরা, ভয় পেও না কোনও কিছুকে। প্রতিক্রিয়া দেখাও সামাজিকভাবে। যদি পারো, প্রথাভাঙার সংস্কৃতিকে অনুশীলন করো। তোমার মাধ্যম এবং বিবেকের প্রতি অনুগত থেকে ঝুঁকি নাও। এটা করতে গিয়ে এগিয়ে যাও বা ধ্বংস হও। I wish you all a very tough time.’’
এ বছরের ১৪ মে শুরু হল মৃণাল সেনের জন্মশতবর্ষ। আধুনিক বাংলা সিনেমার পিতা এবং জ্যেষ্ঠতাত হিসেবে আমি কাদের কথা ভাবছি সেটা পাঠক সহজেই অনুমান করে নিতে পারেন (এই বিবেচনা বয়সের বিচারে আদৌ নয়, কারণ এঁদের মধ্যে একজনের জন্মশতবর্ষ আসতে আরও দু’বছর বাকি)। সেক্ষেত্রে মৃণাল সেন যেন আমাদের অন্তরঙ্গ ছোটো কাকা যাঁর প্যাকেট থেকে সিগারেট শেয়ার করে আমরা অনায়াসে সিনেমা নিয়ে, সমাজ নিয়ে, পরিবর্তমান সময় ও বাস্তবতা নিয়ে কথা চালাচালি করতে পারি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মৃণাল সেন যে ভাবে আত্নজীবনী লিখেছেন, বাংলা চলচ্চিত্রের বিখ্যাত ত্রিমূর্তির বাকি দু’জন তো সেরকম কিছু লেখেননি (তৃতীয় ভুবন, প্রথম আনন্দ সংস্করণ, আনন্দ পাবলিশার্স, ২০১১)। সেখান থেকে যে মানুষকে আমরা আবিষ্কার করি তিনি এমন একজন শিল্পী যিনি দূরতর গ্রহের বাসিন্দা অসম্ভব প্রতিভাবান কেউ নন, বরং তাঁর প্রতিভা ব্যর্থ হতে হতে, ভুল করতে করতে, ভুল সংশোধন করে নিজেকে আরও নিখুঁত করতে করতে নিজেকে বিকশিত করেছে। তাঁর নিজের ভাষায়, ‘‘I travelled a long and difficult way-difficult, because I did not know how to walk. I learnt through experience.’’
এই আন্তরিক উচ্চারণ শোনার পরে আমাদের মনে হয়, প্রতিভাকে যাঁরা রহস্যময়তার আড়ালে রাখতে পারেন, তাঁরা ছাড়াও অন্য মানুষ অনেক সাধারণ জায়গা থেকে শুরু করেও একটা উচ্চতাকে ছুঁতে পারেন। এর মানে কিন্তু এই নয় যে মৃণাল সেনের প্রতিভা ছিল না। এর মানে এটাই যে, প্রতিভা যে সাধনা, পরিশ্রম ও আত্নবিশ্লেষণের ফসল, তাকে তিনি কখনও আড়াল করে রাখতে চাননি। প্রথম ছবি ‘রাতভোর’ (১৯৫৫) এর বিপর্যয় দিয়ে শুরু করে ভুবন সোমের (১৯৬৯) সাফল্য পর্যন্ত যে পর্যায়, যেখানে ‘নীল আকাশের নীচে’-র (১৯৫৯) বা ‘আকাশ কুসুম’ (১৯৬৫) এর মোটামুটি বাণিজ্যিক সাফল্য বা ‘বাইশে শ্রাবণ’ (১৯৬০) এর শৈল্পিক সাফল্য পৃথক আলোচনার বিষয়, সেখানে আমরা অবাক হয়ে যাই তাঁর রাজনৈতিক চিত্ররাজির প্রথম ছবি ‘ইন্টারভিউ’ (১৯৭০) এর নিরীক্ষাশীলতা দেখে। সিনেমার ভাষার এই রাজনৈতিকতা তিনি একদিনে অর্জন করেছেন বা শুধু সিনেমার থেকেই পেয়েছেন এমন নয়। তাঁর বই পড়লে, তাঁর সম্পর্কে অন্যদের লেখালেখি পড়লে বোঝা যায় মৃণাল সেন নিরন্তর সাহিত্য, থিয়েটার, সিনেমা নিয়ে কথা বলে গেছেন, বহু আড্ডা ও তর্কবিতর্কে যোগ দিয়েছেন, আন্তর্জাতিক মানুষ হিসেবে পৃথিবীর সর্বত্র বন্ধু গড়ে তুলেছেন যার মধ্যে সিনেমা জগতের তাবড় ব্যক্তিত্বরা তো আছেনই, আছেন গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের মতো সাহিত্যিকও। এই যাবতীয় অভিজ্ঞতা আর সময়ের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার আর্তি তাঁকে বিশিষ্ট করেছে।
ইন্টারভিউ ছবিতে এমন অনেক কিছুই হয় যা ভারতীয় সিনেমায় প্রথম। সিনেমাটির প্রধান চরিত্র রঞ্জিত মল্লিককে যে ভাবে উপস্থাপিত করা হয় সেটাই ভারতীয় ছবিতে নতুন। যাঁরা চলচ্চিত্রের আগ্রহী ছাত্র তাঁরা হয়তো সিনেমা ভেরিতে স্টাইল, ব্রেখটিয় অ্যালিয়েনেশন তত্ত্বের প্রয়োগ (অনেক বার এই ছবিতে দর্শকদের উদ্দেশ্যে সরাসরি চরিত্রদের কথা বলতে দেখা যায়) ইত্যাদির কথা বলবেন। মৃণাল সেন এই ছবিতে ভুবন সোমের কৌতুকময় স্টাইলের অনুবৃত্তি দিয়ে শুরু করেও সমসাময়িক ক্রোধের রাজনীতি, প্রতিবাদের রাজনীতির আবহকে বোঝার চেষ্টায় পৌঁছে যান। এখানে ইন্টারভিউয়ের জন্য প্রধান চরিত্র রঞ্জিত মল্লিক (এটি তাঁর প্রথম ছবি এবং এখানে তিনি নিজের নামেই অভিনয় করেছেন আবার অভিনয় যে করেছেন সেটাও দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে, ক্যামেরাম্যান কে কে মহাজনের উপস্থিতি সহ) একটি কোট জোগাড় করতে ব্যর্থ হয়। চাকরিটি শুধু এই কারণে না পাওয়ায় তার ক্রোধের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সে একটি শোরুমের কাচ ভেঙে একটি ম্যানিকুইনের গা থেকে কোট খুলে নেওয়ার চেষ্টা করে। এর সঙ্গে আমাদের কলোনিয়াল হ্যাংওভারের ইতিহাস, ভিয়েতনাম-সহ দেশে দেশে ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে লড়াই, কলকাতার রাস্তায় প্রতিবাদের মিছিল— সবকিছুকেই একটা ঐক্যসূত্রে বাঁধার চেষ্টা করা হয়। এই ছবি থেকে পরবর্তী ছবি ‘কলকাতা ৭১’ (১৯৭২) ছবিতে ক্রোধের বিস্তারকে আরও বৈপ্লবিকভাবে ধরার চেষ্টা তাই অনিবার্য ছিল।
এই ছবি শুরু হয় এক কাল্পনিক বিচারশালার দৃশ্য দিয়ে। যেখানে শপিং উইন্ডো ভাঙা এবং ম্যানিকুইনকে বিবস্ত্র করার অপরাধে রঞ্জিৎ মল্লিকের বিচার হয়। সেখান থেকে ১৯৩৩, ১৯৪৩, ১৯৫২— এই তিন সালের পটভূমিকায় তিনটি কাহিনিকে হাজির করেন লেখক যেগুলো ১৯৭১ সালের পটভূমিকায় বিদ্রোহ ও পরিবর্তনের আকাঙ্খায় পরিণতি পায়। এই চারটি আখ্যানের মাঝে ধুয়োর মতো ফিরে আসে একটি কুড়ি বছরের ছেলের ধারাভাষ্য যে হাজার বছর ধরে পথ হাঁটছে আর দারিদ্র, বঞ্চনা এবং শোষণের ইতিহাসকে প্রত্যক্ষ করে চলেছে। মৃণাল সেন জানতেন, দারিদ্র আর ক্ষুধার স্বাভাবিক পরিণতি ক্রোধ, সামাজিক ক্রোধ। মৃণালের একটি প্রিয় উদ্ধৃতি ছিলো ‘ক্ষুধা আর ক্রোধের মধ্যে বিভাজক রেখাটি খুবই সরু’। তাই সেই ক্ষুধার আখ্যানকে ক্রোধের চিত্রণে বদলে দেওয়ার মধ্য দিয়ে ‘কলকাতা ৭১’ সর্বার্থেই একটি সার্থক রাজনৈতিক ছবি হয়ে ওঠে। এরপর পদাতিক (১৯৭৩) আর কোরাস (১৯৭৪)— এই রাজনৈতিক সিনেমার বৃত্তটিকে সম্পূর্ণ করে। এর মধ্যে পদাতিকে মূল বিপ্লবী চরিত্রটির আত্নসমালোচনার বয়ান শুনে অনেকে ছবিটিকে প্রতিক্রিয়াশীল আখ্যা দিতেও পিছপা হননি, বিশেষত নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত মানুষজন। এই ছবির প্রধান চরিত্র সুমিত (অভিনয়ে ছিলেন ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়) পার্টি নেতৃত্বের কাছে বিপ্লবের অনিবার্যতাকে স্বীকার করেও যে প্রশ্নগুলি তোলেন তার মধ্যে অন্যতম ছিল শত্রুমিত্র চিনতে ভুল করা, শিক্ষাঙ্গনে আগুন লাগানো, মূর্তিভাঙার রাজনীতি ইত্যাদি। এই সমালোচনা বা মৃণাল সেনের বিশ্লেষণের সঙ্গে সবাই একমত না-ও হতে পারেন। কিন্তু পরবর্তী সময় প্রমাণ করেছে আত্মসমালোচনার প্রয়োজনীয়তা, যেটা সেই উত্তাল সময়ে রাখার সাহস অন্তত মৃণাল সেন দেখিয়েছিলেন।
ওই দীর্ঘদেহী ভদ্রলোক পুণে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে ভাবী চলচ্চিত্র পরিচালকদের সামনে বক্তব্য রাখছেন। বলছেন, ‘‘নবীন বন্ধুরা, ভয় পেও না কোনও কিছুকে। প্রতিক্রিয়া দেখাও সামাজিকভাবে। যদি পারো, প্রথাভাঙার সংস্কৃতিকে অনুশীলন করো। তোমার মাধ্যম এবং বিবেকের প্রতি অনুগত থেকে ঝুঁকি নাও। এটা করতে গিয়ে এগিয়ে যাও বা ধ্বংস হও। I wish you all a very tough time.’’