অনির্বাণ বিশ্বাস
‘দিওয়ার’ সিনেমায় দুই ভাইয়ের সেই বিখ্যাত ডায়ালগটি মনে আছে?
বিজয় বর্মা (অমিতাভ বচ্চন) বলছেন, ‘‘… আজ মেরে পাস বিল্ডিং হ্যায়, প্রপার্টি হ্যায়, ব্যাঙ্ক ব্যালান্স হ্যায়, বাংলা হ্যায়, গাড়ি হ্যায়। ক্যায়া হ্যায় তুমহারে পাস?’’ আর রবি বর্মা (শশী কাপুর) খুব শান্ত ও আবেগভরা কণ্ঠে জবাব দিচ্ছেন, ‘‘মেরে পাস মা হ্যায়।’’
কাট টু। পঞ্চায়েত ভোট, ২০২৩।
পঞ্চায়েত ভোটের দিন ঘোষণা হয়েছে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে। ভোট আগামী শনিবার, ৮ জুলাই। এই একমাসের মধ্যে ভোটের আয়োজন চাট্টিখানি কথা নয়। নীল, লাল, ডান, বাম, গেরুয়া, সবুজ— সব দলের হাতেই সময় কম। তার মধ্যে প্রচার আছে, মনোনয়নপত্র জমা আছে, স্ক্রুটিনি আছে, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার আছে, বাড়ি বাড়ি প্রচার আছে, সভা-সম্মেলন আছে— কাজের অন্ত নেই। স্বাভাবিক কারণেই সব দল এ বারের ভোটে গুরুত্ব দিয়েছে, ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে প্রচার, বৈঠক ও কর্মী-বৈঠকে।
প্যান্ডেলওয়ালাকে খবর দাও রে, মাইকম্যানকে ডাকো রে, বাঁশ পোঁতো রে, শামিয়ানার ব্যবস্থা করো রে— সে এক বিরাট ঝক্কি! এই স্বল্প সময়ে সবটা তো সম্ভব নয়! তা হলে? নেতা-নেত্রীরাও মেজাজ হারাচ্ছেন, ‘‘তা হলে কিছু একটা বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে!’’
ঠিক সেই মাহেন্দ্রক্ষণে, কিঞ্চিৎ ভয় ও সম্ভ্রমের সঙ্গে এক কর্মী শশী কাপুরের স্টাইলে বললেন, ‘‘মেরে পাস ছায়া হ্যায়!’’ অর্থাৎ, সেই কর্মীর একটি আমবাগান আছে। মানে প্রখর রোদ-গরমে ছায়া আছে। সেখানে দিব্যি কর্মী-সম্মেলন সেরে ফেলা যায়। কারও কারও কি তখন মনে পড়ে যাচ্ছিল সুকুমার রায়ের লেখা সেই লাইন দু’টি— ‘‘পাতলা ছায়া, ফোক্‌লা ছায়া, ছায়া গভীর কালো—/গাছের চেয়ে গাছের ছায়া সব রকমেই ভালো।’’
ছায়ার মায়ায় ‘ইউরেকা’ বলেই নেতা কিংবা নেত্রী দিলেন পিঠ চাপড়ে। কর্মীও গদগদ। চারপাশে একবার মোলায়েম তাকিয়ে ‘কেমন দিলাম’ গোছের হাসিটি তিনি হাসতে যাবেন ঠিক তখনই ছিটকে এল বেমক্কা প্রশ্নটা— ‘‘রোদে গরমে বাগানের ছায়া ভালো। কিন্তু যদি বৃষ্টি আসে?’’ ওই কর্মীর ‘ছায়াবাজি’ যখন প্রায় ‘পানসে’ হওয়ার জোগাড় ঠিক সেই সময় আর এক কর্মী অমিতাভ বচ্চনের কায়দায় হাল ধরলেন, ‘‘মেরে পাস চাতাল হ্যায়।’’
হয়ে গেল মুশকিল আসান! রোদে-গরমে ছায়া। আর ঝড়-বৃষ্টিতে চাতাল। মোদ্দা কথা মাথার উপর কিছু একটা থাকলে বেশ সাহস পাওয়া যায়। সে ছায়া হোক বা চাতাল, নেতা-মন্ত্রীর হাত হোক বা প্রশাসনের নেকনজর!
ছায়া বা চাতাল তো আর কোনও বিশেষ রাজনৈতিক দলের সম্পত্তি নয়, এ দু’টি জিনিস কমবেশি সব দলের লোকজনেরই আছে। অতএব, দলে দলে এই ‘আইডিয়া’ রটে গেল ক্রমে। ছায়া কিংবা চাতালের মালিকদের ভোটের বাজারে কদর বাড়ল। নেতা-নেত্রীরা স্বস্তির শ্বাস নিলেন। রক্ষা পেলেন কর্মীরা।
সকালে কোনও দল বাড়ি বাড়ি প্রচার সেরে‌ দুপুরে বেছে নিল আমবাগান। কোনও দল আবার বিকেলে দোরে দোরে ঘুরে সন্ধ্যায় খুঁজে নিল নিকোনো চাতাল। কোনও দল আবার দিনভর দেওয়াল লিখন, টোটো কোম্পানি সেরে ফিরতে ফিরতে ছায়া কিংবা চাতাল কোনওটারই নাগাল পেল না। সে কর্মসূচি শিকেয় না উঠলেও তোলা রইল পরের দিনের জন্য।
সে না হয় রইল! কিন্তু জনতা জনার্দনও কিছু কম যায় না। সব কিছুতেই তাদের ‘বক্রোক্তি’ থাকবে। এখানেও আছে। বলছে— ‘‘এখন তো সবাই ছায়ার খুব কদর করছে। অন্য সময় যখন বৃক্ষনিধন যজ্ঞ চলে তখন তো আর কারও দেখা মেলে না। সবুজ বাঁচানোর দায় কি শুধু আমাদের?’’
বলাই বাহুল্য, এ সবুজের সঙ্গে আবিরের কোনও সম্পর্ক নেই!