সন্দীপন মজুমদার

মিলান কুন্দেরা আমাকে শিক্ষিত করেছিলেন। সাহিত্যের শিক্ষায়। জীবনের শিক্ষায়। তাঁর প্রথম যে উপন্যাসটা পড়েছিলাম সেটা ‘লাইফ ইজ এলসহোয়ার’। জীবন অন্যত্র আছে। হ্যাঁ, এটাই তো রোমান্টিক বিপ্লবীদের কল্পভূমি। অন্য জীবন। এই স্বপ্ন রোম্যান্টিকদের, কবিদের, বিপ্লবীদের। এইটুকু পর্যন্ত আমরা জানতাম। কিন্তু কুন্দেরা দেখিয়ে দিলেন রোমান্টিকতা আত্মহননের নামান্তর হতে পারে। বিশেষত কম্যুনিস্ট আদর্শবাদ একজন কবিকে ভাবাতে পারে যে তাঁর কবিতারচন আসলে এক বুর্জোয়া অবশেষ যাকে ‘সর্বহারা র সংস্কৃতি’র পায়ে বলি দিতে হবে। এটাই হবে তাঁর সঠিক আত্মত্যাগ। লাইফ ইজ এলসহোয়ারের নায়ক জেরোমিল সেটাই করেছিল।
কুন্দেরার অন্যতম বিতর্কিত উপন্যাস ‘বুক অব লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং’। সেখানে  তিনি  কবি ও ফাঁসুড়েকে এক করে দেখিয়েছিলেন। পল এলুয়ার, অন্যতম শ্রেষ্ঠ বামপন্থী কবি, যাঁর কবিতা আমাদের প্রিয়, তিনি যখন ‘কম্যুনিস্ট আদর্শবাদের’ দায়বদ্ধতা থেকে হাঙ্গেরির কবি জাভিস কালান্দ্রার কম্যুনিস্ট সরকারের হাতে মৃত্যুদণ্ডের প্রতিবাদ করতে পারেন না তখন কুন্দেরা এই বৈপরীত্যকে এ ভাবেই দেখান আমাদের। কুন্দেরা আমাদের  শিখিয়েছেন উপন্যাসের ন্যারেটিভে প্রবেশ করা মাত্র দুনিয়ার সব সত্য আপেক্ষিক সত্যে পরিণত হয়। এখানে কোনও চরম সত্য নেই, কোনো অলঙ্ঘনীয় নিয়ম নেই। সেই অর্থে  উপন্যাস পৃথিবীর সব অচলায়তনের দিকে ছুড়ে দেওয়া এক চ্যালেঞ্জ। যে উপন্যাস নিশ্চিত সত্যের কারবারি, তা অ্যান্টি কম্যুনিস্ট হলেও কুন্দেরার মতো সাফারার এবং ডিসিডেন্ট সাহিত্যিকের কাছে অপাঙক্তেয়– যেমন সলঝেনিৎসিনের উপন্যাস। যে উপন্যাস অস্তিত্বের কোনও একটা গোপন প্রকোষ্ঠকে নতুন করে চেনায় না আমাদের— তা-ও ব্যর্থ উপন্যাস কুন্দেরার মতে।
আর কৌতুক? তা যেন একজন সুরসিক মানুষের মতোই সাহিত্যের গুণ বলে মনে করেন কুন্দেরা। নিজের লেখা প্রথম উপন্যাস ‘জোক’ যেখানে প্রধান চরিত্রযুগল বিশ্ববিদ্যালয়ের  এক ছাত্র ও এক ছাত্রী  নিজেদের মধ্যে পুরুষাঙ্গকে ‘ট্রটস্কি’ বলে সাঙ্কেতিক নামে ডেকে কী ভয়ানক বিপদ ডেকে এনেছিল সেখানেই এই ট্র্যাজিকমেডিকে আমরা প্রথম চিহ্নিত করি। এরপর থেকে তাঁর প্রতিটি লেখায় আমারা এর শাণিত প্রয়োগ দেখেছি। শুধু এই কারণেই ‘ডন কুইক্সোট’ (স্প্যানিশ কায়দায় লিখলাম না) তাঁর অন্যতম প্রিয় উপন্যাস তা অবশ্য নয়, একটা গোটা যুগের ভ্যালু সিস্টেমকে নিয়ে তা মস্করা করার সাহস দেখিয়েছিলো বলেই তা প্রিয়। আশ্চর্য এটাই যে নিবিষ্ট পাঠক কুন্দেরা (দ্য আর্ট অব নভেল, টেস্টামেন্ট বিট্রেড এবং এনকাউন্টার পুস্তকত্রয়ী তার প্রমাণ) কাফকার উপন্যাসে, এমনকি যৌনদৃশ্যের বর্ণনায় কমিক এলিমেন্ট কী ভাবে আছে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে শিখিয়ে  দেন।
আর তাঁর ক্রাফট? সে নিয়ে আমি আর কী করে কিছু বলব? লাইফ ইজ এলসহোয়ারের জেরোমিলের ডাবল জেভিয়ার, দ্য বুক অফ লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিংয়ের অদ্ভুত সিন্থেটিক স্ট্রাকচার যেখানে একটি চ্যাপ্টারের মধ্যে ডায়েরি, ফিকশন, ইতিহাস, সঙ্গীত সমালোচনা, ফ্যান্টাসি সব মিলে যায়, কিংবা ‘আনবেয়ারেবল লাইটনেস অব বিয়িং’ উপন্যাসের শুরুর ফিচেল দার্শনিকতা, টমাস যে জীবনকে পালকের মতো হালকা রাখবে বলে কোনও মেয়েকেই শারীরিক মিলনের পরে তার বিছানায় রাত্রি যাপন করতে দিত না— তার পালটে যাওয়া  জীবন, কারেনিনস লাফ (কারেনিন একটি কুকুরের নাম) নামে আর একটি অধ্যায়ে ঈশ্বর সম্পর্কিত সুভাষিতাবলী (যদি ঈশ্বর মানুষকে নিজের প্রতিরূপ হিসেবেই তৈরি করে থাকেন তাহলে স্বাভাবিক প্রশ্ন ঈশ্বর কি মানুষের মতো মলত্যাগ করেন ?) বা ইমমরটালিটি উপন্যাসে প্রফেসর অ্যাভেরেনিয়াসের মতো চরিত্র, যিনি রাত্রিবেলা জ্যাকেটের আড়ালে চাকু নিয়ে বেড়িয়ে দণ্ডায়মান গাড়িগুলির টায়ার ফাঁসাতে ফাঁসাতে চলে যান একক প্রতিবাদ হিসেবে— এসব আমাদের অনেকখানি মানুষ করেছে। এতক্ষণ গৌরবে বহুবচন ব্যবহার করলাম বটে। তবে অন্তত আমাকে।
কুন্দেরা নোবেল পাননি বলে একটু খারাপ লাগত। পরে মনে হতো তাতে তো আর প্রিয়ত্বের ঘাটতি হয় না। তিনি চলে গেলেন মানে আমার ইউরোপীয় এক দাদু চলে গেলেন। আমার ইউরোপীয় দাদু, দিদা, ঠাকুমা, দিদিমারা এক এক করে চলে যাচ্ছেন। এঁরা আমাকে গড়েছেন। দেশে দেশে আমার এই দাদু, দিদা, ঠাকুমারা ছড়িয়ে আছেন। তাতে আমার বাঙালিয়ানায় টান পড়েনি একটুও। এমনকি কুন্দেরা আমাকে বামবিরোধীও করেননি রাজনীতিগতভাবে। শুধু সচেতন করেছেন, অনেক মোহ আর বিভ্রান্তি ভেঙে দিয়েছেন, শক্ত মানসিক জমির উপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। এই প্রাপ্তি ভুলে যাব, এমন অকৃতজ্ঞ আমি নই।

(লেখকের বক্তব্য নিজস্ব। ফিচার ছবি ইন্টারনেট থেকে নেওয়া। লেখা পাঠাতে পারেন এই মেলে— sadakalonewz@gmail.com)