দেবাশিস মুখোপাধ্যায় (দে মু)
আজ উত্তমকুমারের মৃত্যুদিন। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ উত্তমকুমারে ছেয়ে গেছে। মনে পড়ে গেল, ১৯৮০ সালের ২৫ জুলাই আনন্দবাজার-সহ সব ক’টা বাংলা কাগজের প্রথম পাতায় আট কলম জুড়ে ছিল উত্তমকুমারের ছবি-সহ বিস্তারিত মৃত্যুসংবাদ। আর পাঁচের পাতার এক কোণে ছোট্ট একটা ডাকটিকিট মাপের ছবি-সহ ছিল তাঁর মৃত্যুসংবাদ।
তিনি বিনয় ঘোষ।
ছ’বছর আগে তাঁর জন্মশতবর্ষ পূর্তি হয়ে গেছে। না, বাঙালি তাঁকে মনে রাখেনি। আনন্দবাজারের রবিবাসরীয়তে সুধীর চক্রবর্তীর একটা প্রবন্ধ ছাড়া আর কোথাও তেমন কিছু চোখেই পড়েনি। কিন্তু এই অবহেলা তাঁর প্রাপ্য ছিল না মোটেই। আধুনিক সমাজবিজ্ঞান, আঞ্চলিক ইতিহাস, লোকসংস্কৃতিকে তিনিই সহজ গদ্যে সাধারণ পাঠকের কাছে তুলে নিয়ে এসেছিলেন।
বাংলার সংস্কৃতিকে তিনিই প্রথম সুলিপিবদ্ধ করে গেছেন। সাংবাদিকতার হাত ধরে তাঁর লেখার জগতে প্রবেশ। পরে শুরু করেন সাহিত্য সমালোচনা। বাংলাদেশে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রতিফলন কী ভাবে ঘটে, তার বিবরণ লিখেছিলেন ‘বাংলার নবজাগৃতি’ বইয়ে। চতুর্থ পর্বে বিষয় হিসেবে বেছে নেন কলকাতার সংস্কৃতি। ইতিহাসের প্রেক্ষিতে নতুন রূপে, নতুন ব্যাখ্যায় শহরটিকে আবিষ্কার করেন। এরপরে হাত দেন বাংলার সংস্কৃতি বিষয়ে। বাংলার সমাজ, লোকাচার, লোকনীতি বিষয়ে অমূল্য সব গ্রন্থ আকরের স্থান পেয়েছে। পরবর্তী সময়ে সংকলন করেছেন পুরনো সংবাদপত্রের বিষয়ভিত্তিক সংবাদ। শেষ পর্বে লিখেছেন বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের জন্যে পাঠ্যপুস্তক। যদিও প্রাজ্ঞ বিনয় ঘোষ শেষ পর্যন্ত আমাদের কাছে সংস্কৃতিবিজ্ঞানী রূপেই রয়ে গেছেন।
তিনিই দেখিয়ে দিয়েছিলেন দেশের প্রাকৃতজনের প্রাণবন্ত ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে কেমন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে সেখানকার কারুশিল্প। তিনিই আজ থেকে ৬০-৬৫ বছর আগে সাবধান করে দিয়েছিলেন, বাঙালির জীবনের সঙ্গে শিল্পকর্মের প্রত্যক্ষ ঘনিষ্ঠ সংযোগ ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। বাংলার লোকশিল্প দ্রুত নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী আমরা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছি।
আমি ছিলাম তাঁর একনিষ্ঠ ভক্ত। মানে, তাঁর লেখার। যখনই যা পেতাম গোগ্রাসে গিলতাম। ওঁর অনেক বই তখন অপ্রাপ্য ছিল। এখনও তাই। তবে আশার কথা ‘পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি’ এবং কালপেঁচার কয়েকটি বইয়ের সংকলন পাওয়া যায়।
তাঁর কয়েকটি কাজের বিষয়ে আমার বিরূপ প্রতিক্রিয়া ছিল। সে সব লেখার জায়গা এটা নয়। তবে একটা ব্যাপার জানাতে চাই। বিনয় ঘোষের গ্রন্থসংগ্রহ ছিল ঈর্ষণীয়। বিশেষ করে সমাজবিজ্ঞানের বই। কিন্তু তিনি জীবিত থাকতেই সংগ্রহের সিংহভাগ অস্ট্রেলিয়ার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। কেন, এটা কেন করেছিলেন তিনি? আমি জানি না।
(লেখকের বক্তব্য নিজস্ব। ফিচার ছবি ইন্টারনেট থেকে নেওয়া। লেখা পাঠাতে পারেন এই মেলে— sadakalonewz@gmail.com)