কাবেরী বিশ্বাস

টলটলে জলে ভরা, গাছ-গাছালির ছায়া ঘেরা একটা পুকুর— এ দৃশ্য আমাদের অনেকের বড় প্রিয়। তবে এমন দৃশ্য আর হয়ত বেশিদিন দেখা যাবে না। গত তিন দশকে ভারতবর্ষ হারিয়ে ফেলেছে তার পাঁচটি জলাভূমির মধ্যে দু’টি। ইদানীং আমরা পরিবেশ নিয়ে একটু আধটু সচেতনতা দেখাচ্ছি। গ্রীষ্মে তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড ছুঁয়ে ফেললে, ‘গাছ লাগাও প্রাণ বাঁচাও’ বলে স্লোগান তুলছি। বিশ্ব-উষ্ণায়ন কমাতে গাছের মতো বন্ধু বেশি নেই।
কিন্তু বিশ্ব উষ্ণায়ন রুখতে গাছের মতো আর এক বন্ধুর কথা আমাদের মনে পড়ছে না এখনও। অরণ্যের চেয়ে তিন গুণ দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে যে জলাভূমি, সে এখনও অবহেলিত। শুধু আমি আপনি নই, যাঁদের হাতে এই ভুবনের পরিবেশ রক্ষার ভার তাঁদের কাছেও সে দুয়োরানি। ২০২১ সালে গ্লাসগোতে COP 26 সম্মেলনে আওয়াজ উঠেছিল জলবায়ু পরিবর্তন রুখতে পৃথিবীর অরণ্যসম্পদকে বাঁচাতে হবে। কিন্তু জলাভূমি বাঁচানোর ব্যাপারে কেউ উদ্যোগী হননি। বলাই বাহুল্য, সে দাবিও কেউ তোলেননি।
জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে চাই অরণ্য, গাছ কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে পৃথিবীর উষ্ণতা কমাবে, দেবে অক্সিজেন। আর যে জলাভূমি গাছের চেয়েও বেশি কার্বন শোষণ করে, অক্সিজেনও দেয়, বরং বাড়তি দেয় জল, সেই জীবনদায়িনীকে ভুলে থাকা মানে যে সর্বনাশকে আহ্বান করা সেটা এখনও মানুষ বুঝতে পারছে না। বিপর্যয় ঘটে চলেছে, কিন্তু আমরা না দেখে শিখছি না ঠেকে শিখছি। ২০২২ সালের বন্যায় আমাদের পড়শি দেশ পাকিস্তানের এক তৃতীয়াংশ জলের নীচে চলে গিয়েছিল। ৩৩ মিলিয়ন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হলেন, ১৩১৪ জন মারা গেলেন। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর মধ্যে আছে সিন্ধু প্রদেশের “মানচার” হ্রদের আশপাশ। মানচার পাকিস্তানের বৃহত্তম মিষ্টি জলের হ্রদ। সেটির পাড় বিদীর্ণ হয়ে ভেসে গেল কয়েশো গ্রাম। কেন এমন হল? বছরের পর বছর হ্রদের বুকে জমা করা হয়েছে আবর্জনা। কমেছে তার জলধারণ ক্ষমতা। তাই সিন্ধু উপত্যকায় অতিবৃষ্টি আর উষ্ণায়নে গলে যাওয়া বরফের জল যখন হ্রদে জমা হল, তখন ‘মানচার’-এর বাঁধ ভাঙল।
জলাভূমির হারিয়ে যাওয়া, টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়ার ফলে সারা পৃথিবী জুড়ে জলচক্র ভেঙে পড়ছে। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে ওয়েটল্যান্ড ইন্টারন্যাশানালের সিইও জে. ম্যাডউইক চিহ্নিত করেছেন চারটি ‘D’। নদীতে বাঁধ বা ড্যাম, ছোট ছোট বাঁধ বা ডাইক যা নদীকে তার প্লাবনভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়, ড্রেন যা জলাভূমির জল বের করে নেয় চাষের  কাজে, ডিফরেস্টেশন বা বনভূমি ধ্বংস হওয়ার ফলে মাটি আলগা হয়ে বৃষ্টির জলে ধুয়ে এসে জলার বুকে জমা হওয়া।
এটা যেমন বন্যা রুখতে জলাভূমির ভূমিকাকে চিনিয়ে দেয়, তেমনি খরা রুখতে জলাভূমির ভূমিকাকে তুলে ধরে চিনের বৃহত্তম মিষ্টি জলের হ্রদ— পয়াং। এই প্রাকৃতিক জলাশয় গড়ে উঠেছে ইয়াংসি নদীর প্লাবনভূমিতে। বৃষ্টি না হলেও নদীর ধারাকে মোহনার দিকে অব্যাহত রাখত এই হ্রদ। কিন্তু তার জলধারণ ক্ষমতা কমে গেছে। হ্রদের ইয়াংসি নদীর দিকে বহির্গমন খালের থেকে বালি কেটে তুলে নেওয়ায় হ্রদের জল বেশি পরিমাণে বেরিয়ে যাচ্ছে। জলের সঞ্চয় কমে যাওয়ায় শুখা মরসুমে পর্যাপ্ত জল পাওয়া যাচ্ছে না। কখনও বন্যা, কখনও খরা। প্রকৃতির নিয়ম ভেঙে, মানুষের অবৈজ্ঞানিক পদক্ষেপে তৈরি হচ্ছে সঙ্কট। হ্রদ, পিটল্যান্ড, নদীর প্লাবনভূমি, ব-দ্বীপ আর কৃষিজমির মাঝে থাকা অসংখ্য ছোট ছোট জলাশয় আমাদের অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ। এরাই জলচক্রে বাফারের কাজ করে আটকে দেয় বন্যা, খরা। বাঁচিয়ে রাখে মাটির উর্বরতা, পুষ্ট করে ভূগর্ভস্থ জল ভান্ডার, টিকিয়ে রাখে মিষ্টি জলের জীববৈচিত্র্যের অমূল্য ভান্ডার। জলাভূমির সুস্বাস্থ্য জলবায়ু ও আর্থিক সুস্থিতির প্রাথমিক শর্ত।
জলাভূমি ধ্বংস পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে, সেটা বুঝেও মানুষ তাৎক্ষণিক লাভের আশায় মেতে উঠছে ধ্বংসলীলায়। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জলাভূমি ‘প্যানটানাল’। তিনটি দেশ— ব্রাজিল, বলিভিয়া আর প্যারাগুয়ে জুড়ে এর বিস্তার। গত দু’বছরে এর এক তৃতীয়াংশ পুড়ে গেছে আগুনে। আগুন লাগিয়েছিলেন কৃষকেরা যাঁরা কৃষি জমি হাসিল করতে চাইছেন। কিন্তু সে আগুন ছড়িয়ে গেল ঘাসজমির মধ্যে। ধ্বংস হয়ে গেলে জলাভূমির প্রকৃতির সাথে সাজুয্য রেখে গড়ে ওঠা পুরনো পশুপালন ব্যবস্থা। বিঘ্নিত হল প্রাকৃতিক ভারসাম্য।
পৃথিবীর কোথাও বোধহয় জলাভূমি নিরাপদে নেই। এক গ্রীষ্মের রাতে জার্মানি আর বেলজিয়ামের সীমানায় থাকা আইফেল পর্বত থেকে নেমে এল বন্যার জলের বিধ্বংসী স্রোত। কিল নদীর দু’পাশে বসবাসকারী ২০০ মানুষ ভেসে গেলেন স্ফীত কিল নদীর জলে। এক দশকের মধ্যে এটা ছিল ইউরোপের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বন্যা। স্বাভাবিক ভাবেই জলবায়ু পরিবর্তনকে কাঠগড়ায় তোলা হল। এটা ঠিক যে, বৃষ্টিপাত ছিল অভূতপূর্ব। কিন্তু সেই বৃষ্টি ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠার নেপথ্যের কারণটা ছিল আইফেল পর্বতের ছোট ছোট জলাশয়গুলো ধ্বংস করে ফেলা। এই প্রাকৃতিক স্পঞ্জ শুষে নিত জল আর সে জল ধীরে ধীরে চুঁইয়ে গিয়ে পুষ্ট করত মাটির জলভান্ডার। তাদের না থাকা বিলীন করে দিল মানুষের আশ্রয়, জীবন।
জলাভূমির হারিয়ে যাওয়া, টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়ার ফলে সারা পৃথিবী জুড়ে জলচক্র ভেঙে পড়ছে। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে ওয়েটল্যান্ড ইন্টারন্যাশানালের সিইও জে. ম্যাডউইক চিহ্নিত করেছেন চারটি ‘D’। নদীতে বাঁধ বা ড্যাম, ছোট ছোট বাঁধ বা ডাইক যা নদীকে তার প্লাবনভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়, ড্রেন যা জলাভূমির জল বের করে নেয় চাষের  কাজে, ডিফরেস্টেশন বা বনভূমি ধ্বংস হওয়ার ফলে মাটি আলগা হয়ে বৃষ্টির জলে ধুয়ে এসে জলার বুকে জমা হওয়া।
এটা বোঝা দরকার যে, যখন একটি জলাভূমি ধ্বংস হয়ে যায় তখন একটি বাস্ততন্ত্রের সুছন্দে চলার সিস্টেমটা ভেঙে পড়তে শুরু করে। কিন্তু আমাদের কাঁধে চেপে থাকা উন্নয়নের ভূত আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। বিপন্ন হয় জীবন, জীবিকা, বাসভূমি। আমাদের দেশেও প্রতিবছর বন্যায় ভেসে যাওয়া হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখন্ড, অসম, কেরল, মুম্বই, চেন্নাই, হায়দ্রাবাদের ছবি সেটাই প্রমাণ করে দেয়। আমরা ভাবি, জলাভূমি যায় তো যাক উন্নয়নের সুফল পুষিয়ে দেবে সে সামান্য ক্ষতি। কিন্তু বাস্তবে লাভ-ক্ষতির হিসেব মেলাতে গেলে বোঝা যায় এই ক্ষতি মানুষের অস্তিত্ব রক্ষাই দুরূহ করে তুলছে। ভারত সরকারের ন্যাচারাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অথরিটি-র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ক্রমশ বাড়ছে বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ। ১৯৯৬ সালের আগের ৫৩ বছরে যা ছিল বছরে গড়ে ১৮০৫ কোটি টাকা, ১৯৯৬ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত তা দাঁড়িয়েছে বছরে ৪৭৪৫ কোটি। আর যে সম্পদ চলে গেলে আর ফেরানো যায় না সেই মানব সম্পদ? প্রতি বছরে মারা যান ১৬০০ জন।
আমরা পরিবেশ ধ্বংস করছি আর তার মাশুল গুনছি জীবন, সম্পদ সব হারিয়ে। ভারতে প্রতি বছর হারিয়ে যাচ্ছে ২-৩% জলাভূমি। গত তিন দশকে আমরা হারিয়েছি ৩০% প্রাকৃতিক জলাভূমি। চেন্নাই হারিয়েছে ৯০%, হায়দ্রাবাদ ৫৫%, মুম্বই ৭১%, ব্যাঙ্গালোর ৫৬%, আহমেদাবাদ ৫৭% আর আমাদের রাজধানী যে এখন ভাসছে জলে, তার গেছে ৩৮% জলাভূমি। এই সব অত্যাধুনিক শহর প্রতি বছর নিয়ম করে ভাসে বন্যায়। শুধু বন্যা নয়, নীতি আয়োগের রিপোর্ট অনুযায়ী এরা সবাই আছে চূড়ান্ত জল-সঙ্কটে। দু’-এক বছরের মধ্যে তাদের ভূগর্ভে জল ফুরিয়ে যাবে।
‘পরিবেশ ধ্বংস করে উন্নয়ন নয়, চাই পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন’— আরও কত ক্ষতির পরে আমরা এই আওয়াজ তুলব?

(লেখকের বক্তব্য নিজস্ব। ফিচার ছবি ইন্টারনেট থেকে নেওয়া। লেখা পাঠাতে পারেন এই মেলে— sadakalonewz@gmail.com)