শুভম মুখোপাধ্যায়

রাতে নিজের ঘরে চুপচাপ শুয়ে আছি, চোখ বন্ধ করে ঘুমোনোর চেষ্টা করছি। হঠাৎই পাশের ঘর থেকে বাবা-মায়ের কথাবার্তা কানে এলো। বাবা মাকে বলছে,
—আচ্ছা, শুনলাম ওপেনহাইমার বলে একটা সিনেমা বেরিয়েছে। তুমি কি জানো আমাদের ছেলে সেটা দেখেছে কিনা?
মা বলল,
—এরকম কোনও সিনেমার নাম তো আমি শুনিনি! এটা কি বাংলা সিনেমা নাকি হিন্দি?
—আরে, এটা একটা ইংরেজি সিনেমা! অনেকেই সিনেমাটা দেখছে। ফিজিক্স, সায়েন্স, সুপার সায়েন্স, আরও ভারী ভারী সব বিষয় নিয়ে সিনেমাটা বানানো হয়েছে! খবরের কাগজে, ইন্টারনেটেও অনেক লেখালেখি হয়েছে।
—কী যে বলো না! আমাদের ছেলে কি অতটা ইংরেজি বোঝে? স্কুলে তো বরাবরই কোনওরকমে টায়েটুয়ে ইংরেজিতে পাশ করত। ও আবার ইংরেজি সিনেমা দেখবে!
—চুপ করো। পাড়ায়, ক্লাবে আমার প্রায় সব বন্ধুদের ছেলেমেয়েরাই এটা দেখে নিয়েছে এবং বাড়িতে এসে গল্প করেছে। সিনেমাটা বেরিয়েছেও অনেকদিন হল, কই আমাদের বাবু তো ঘরে একবারও সিনেমাটা নিয়ে কোনও কথা বলেনি! তাহলে কি ও সিনেমাটা দেখেনি?
—দেখো, আজকালকার ছেলেপুলেরা কি আর সব কথা বাপ-মাকে শেয়ার করে! হয়তো দেখেছে, আমাদের বলেনি।
—সেটা হতে পারে। শুনলাম সিনেমাটা যুদ্ধ, বোমা, এ সব নিয়ে বানানো। যারা দেখছে অনেকেই ডিপ্রেসড হয়ে যাচ্ছে, দুঃখ পাচ্ছে। তুমি কি এই ক’দিনের মধ্যে বাবুর ভেতর কিছু লক্ষ্য করেছ,‌ যেমন ও একটু স্যাড আছে বা চুপচাপ আছে?
—তা হলেও হতে পারে। এই ক’দিন ধরে তো রাতে ভাত একটু কম খাচ্ছে। ছেলেটা ডিম খেতে ভালোবাসে, আজ দুটো ডিম দিলাম। একটা ডিম খেলো, একটা খেলো না। এমনও হতে পারে যে, তুমি কী সিনেমার নাম বললে, সেই সিনেমা দেখেই ও দুঃখী হয়ে গেছে। এইজন্য আমি তোমায় কত করে বলি সময় থাকতে থাকতেই ছেলের বিয়ে দাও, বিয়ে দাও! তা না তুমি এ সব কানেই নেবে না!
—‌মাথা খারাপ কোরো না! আগে কাল সকালে ওকে জিজ্ঞেস করতে হবে, ওপেনহাইমার দেখেছে কিনা। তারপরে ছেলের বিয়ের কথা ভাবা যাবে।
—কিন্তু তুমি তো বললে সিনেমাটা বিজ্ঞান, বোমা, ‌এ সব নিয়ে বানানো। আমাদের ছেলে কি এইসব সিনেমা বুঝবে? ও তো স্কুলে ভৌত বিজ্ঞানে প্রায় ফেল করত। ভাগ্যিস আমি ঠাকুরের মন্ত্র পড়া পেন এনে দিয়েছিলাম, তাই তো দু’নম্বরের জন্য মাধ্যমিকটা পাশ করল, নইলে খবর ছিল!
—তা অবশ্য ঠিক। ছেলে আমাদের বিজ্ঞানে বরাবরের ঢেঁড়শ। যাই হোক, বাবু সকালে ঘুম থেকে উঠলে তুমি ওকে অবশ্যই জিজ্ঞেস করবে, ওপেনহাইমার সিনেমাটা দেখেছে কিনা। আর যদি না দেখে থাকে তাহলে যেন অবশ্যই দেখে নেয়।
—তাই বলব’খন। আর তেমন হলে আমি আবার ঠাকুরের ফুল এনে পুজো দিয়ে দেব যাতে বাবু সিনেমাটা একটু বোঝে, ওর মাথায় কিছু ঢোকে।
—ঠিক আছে, ঠিক আছে, সে তুমি যা করার কোরো, কিন্তু মনে রাখবে ওপেনহাইমার সিনেমা ওকে দেখতেই হবে, নইলে আমি পাড়ায় গিয়ে মুখ দেখাব কী করে!
—সে না হয় আমি বলব। কিন্তু আজকালকার ছেলেপুলে আমাদের কথা কি শুনবে? যদি বলে সিনেমাটা দেখিনি, বা দেখব না, তখন?
—শুনবে না মানে? শুনতেই হবে। ভালোভাবে বোঝাবে তুমি, তাতে যদি শোনে তো শুনবে, নইলে পিঠে দু’ঘা পড়লেই সব ঠিক হয়ে যাবে। দেখবে না মানে ওর বাপ দেখবে!
—বাপ দেখবে আবার কী কথা! বাপ তো তুমিই। তাহলে তুমিও তো সিনেমাটা দেখতে পারো! আমাকেও নিয়ে যাবে, অনেকদিন কোনও সিনেমা দেখিনি।
—চুপ করো, আমরা এ সব সিনেমা দেখে কী করব? আমাদের কি এ সব সিনেমা দেখার বয়স আছে? বরং শুনলাম দুর্গ রহস্য না কি একটা নতুন বাংলা সিনেমা আসছে ব্যোমকেশ বক্সীর, আমরা বরং সেটা দেখতে যাব!
—এ আবার কী সিনেমা! এই সিনেমাতে কে আছে?
—কেন দেব আছে! শোনোনি?
—ও মাগো! দেব!!!‌ তাহলে তো আমি দেখবই দেখব। এই নিয়ে যেও কিন্তু!
—ঠিক আছে, ঠিক আছে, এখন মাথা খারাপ কোরো না। সকালে উঠে বাবুকে আজকালের মধ্যে অবশ্যই ওপেনহাইমার দেখে আসতে বলো। নাহলে কিন্তু পিঠে যে দু’ঘা পড়বে‌‌ সেটা বলতে ভুলো না!
—হ্যাঁ ঠিক আছে। রাত হয়েছে, এখন ঘুমোও।
রাত গভীর। চারপাশ নিস্তব্ধ। আমি মটকা মেরে নিজের ঘরে এখনও শুয়ে আছি। মনে মনে ভাবলাম, ইংরেজিতে আমি চিরকালের কাঁচা, বিজ্ঞানে আমি বরাবরের ঢেঁড়শ, কিন্তু পিঠে যদি এখন ঘা দুয়েক পড়ে যায়, তাইলে আমায় বাঁচাবে কেডা?

(লেখকের বক্তব্য নিজস্ব। ফিচার ছবি ইন্টারনেট থেকে নেওয়া। লেখা পাঠাতে পারেন এই মেলে— sadakalonewz@gmail.com)