অনিমেষ বৈশ্য

ছেলেবেলায় কত শব্দ শুনিনি। এখন শুনছি। মানে শোনানো হচ্ছে। যদি না-শুনি তা হলে আমি এলিট নই। আমাকে এলিট হতে হবে। যে করেই হোক। সংবাদমাধ্যমে নিত্য এলিট হওয়ার হাতছানি।
ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন বা অন্দরসজ্জা। এই শব্দটা আমি অন্তত ছেলেবেলায় শুনিনি। ঘরের আবার অন্দরসজ্জা কী? আমাদের ঘরের অন্দরসজ্জা ছিল এই রকম: খান কতক পেল্লাই ঘর। প্রতিটা ঘরে খান দুই চৌকি পাতা। সেখানে বাবরের আমলের একটি তোশক। পাড়ার হরিকাকু, কালুজেঠু, আশালতা ঠাকুমা যে যখন খুশি এসে বিছানায় ধপ করে বসে পড়ছেন, তাস পিটছেন, রাজা-উজির মারছেন।
ওই চৌকির নীচে অসংখ্য টিনের কৌটো, ‘সুখে থেকো’ লেখা তোরঙ্গ, কৌটোয় ঠাকুমার তৈরি কুলের আচার, মুড়ির মোয়া, নারকেল নাড়ু। চৌকির নীচে গহিন আঁধার। ওখানেই আছে লালকমল-নীলকমল, ওখানেই তেপান্তরের মাঠ। ঘরে একটা বড় বাঙ্ক, সেখানে গুচ্ছের কাঁসার বাসন, পুরোনো গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকা, কে সি নাগের ছেঁড়া অঙ্কের বই। মায়ের পুরোনো শাড়ি দিয়ে সেই বাঙ্ক ঢাকা। দেওয়ালের ঠাকুর-দেবতার ক্যালেন্ডার, নবদ্বীপ থেকে আনা শ্রীচৈতন্যের উদ্বাহু মৃন্ময় মূর্তি, পেরেকে ঝোলানো কুলো, মোটা শিকের জানলা, একটা যথাসম্ভব অগোছালো কাঠের আলনা, ইতিউতি কাঠের পিঁড়ি, পানের বাটা এবং এক অদ্ভুত মায়ামাখা গন্ধ।
এই হল অন্দরসজ্জা। আমার, আপনার, জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্ল রায়, চারু মজুমদার, কে সি পাল, পঙ্কজ মল্লিক, শিবু, ভোলা, নন্দ, বিলে— সবার। এই অন্দরসজ্জাতেই প্রফুল্ল রায় বিজ্ঞানী হয়েছেন, উত্তমকুমার নায়ক হয়েছেন, মান্না দে গায়ক হয়েছেন, নজরুল কবি হয়েছেন, চারু মজুমদার বিপ্লবী হয়েছেন। কারও ঘরের অমুক কোণে লাফিং বুদ্ধ, তমুক কোণে বনসাই বটগাছ, তমুক কোণে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি হেলিয়ে গণেশের মূর্তি, কিছুই ছিল না। কিন্তু এখন আছে। কারণ আমরা এলিট হচ্ছি। এলিট হচ্ছি মানে লক্ষ লক্ষ কুসংস্কার ছেঁকে ধরছে। আমাদের ভুঁড়ি বাড়ছে। সংবাদমাধ্যম রোজ আমাদের এলিট হওয়ার বাসনায় ধুনো দিচ্ছে। আমরা ভাতকে রাইস বলছি। রাইস খেয়ে উদর স্ফীত হচ্ছে। আমরা জগিং করছি, ওয়ার্কআউট করছি। ব্যায়ামাগারে মুগুর ঘোরানোর নাম যে ওয়ার্কআউট কে তা জানত! আমরা এলিট হচ্ছি। এলিটিজমের ভাষা আলাদা। মুগুর, ডাম্বেল, কুস্তি, ল্যাঙট—মোটেই এলিট শব্দগুচ্ছ নয়। নতুন শব্দ চাই। এখন কেউ আখড়ায় ব্যায়াম করতে যায় না। এখন জিমে ওয়ার্কআউট করতে যায়। কেউ ঘাম ঝরায় না। ক্যালোরি বার্ন করে।
গাঁয়ের রাস্তায় রিবকের টি শার্ট, নাইকির স্নিকার পরে দিনু খুড়োর ছেলে ‘জগিং’ করবে বাপের জন্মে ভেবেছি? এখন শুধু ভাবছি না, দেখছিও। আমরা এলিট হচ্ছি। কত নতুন শব্দ ছেঁকে ধরছে। তুমি যত এলিট, তত একা। আপিসে আলাদা খুপরি (সরি কিউবিকল), তুমি একা। রাস্তায় একা, জগিংয়ে একা, জিমে একা। কেউ আখের গুড় ও অঙ্কুরিত ছোলা এনে বলছে না, ‘খাবি একটু?’ মেপে হাসছি, মেপে খাচ্ছি, এলিট হচ্ছি।
একটা পাখি এক নাগাড়ে শিস দিয়ে যাচ্ছে। আমার ভিতরটা ফালাফালা হয়ে যাচ্ছে। এত রক্ত! বিজবিজে রক্তে ছেঁড়া তুলো, আখের রস, বর্ষার নতুন আমের চারা।
একপশলা বৃষ্টির পর সবাই আমার দিকে চেয়ে আছে। আজ, কাল, পরশু।

(লেখকের বক্তব্য নিজস্ব। ফিচার ছবি ইন্টারনেট থেকে নেওয়া। লেখা পাঠাতে পারেন এই মেলে— sadakalonewz@gmail.com)