সীমান্ত গুহঠাকুরতা
আহা, ছোট ছোট পরিসরে, স্বল্প বাজেটে কী সব অনবদ্য কাজ হচ্ছে আজকাল কলকাতার আনাচে-কানাচে…। ঠিক যেন রবীন্দ্রনাথের সেই ছোটগল্প ‘নাহি বর্ণনার ছটা, ঘটনার ঘনঘটা, নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ’। তবু মনের মধ্যে তার রেশ থেকে যায় বহুক্ষণ।
(১)
বেশ কিছুদিন হল, বাংলা থিয়েটারে সাদামাটা প্রযোজনা নামাবার ঝুঁকি আর কেউ নেন না। কেননা, যুগটাই হল, যাকে বলে ‘গ্র্যাঞ্জারের’। প্রচুর শব্দ, প্রচুর আলো, প্রচুর নাট্যঘন মুহূর্ত, সর্বোপরি একটা জমকালো স্টার কাস্টিং ছাড়া আজকাল নাটকের দর্শক টানা ভারী মুশকিল।
অথচ একাডেমির মঞ্চে সেদিন মাত্র দু’টি চরিত্র— হিন্দু ফিল্ম ডিরেক্টর স্বামী আর তাঁর মুসলিম স্ত্রী। আর মঞ্চের মাঝখানে একটা বড় সাদা মশারির নীচে সাদা সোফাসেট আর সাদা কম্পিউটার টেবিল। ব্যস। আবহের বৈচিত্র্য, আলোর কারিকুরি কিছুই নেই। দেখার জন্য শুধু দুই অভিনেতা-অভিনেত্রীর দাপুটে অভিনয়, শোনার জন্য শুধু তাঁদের আপাতভাবে সাদামাটা সংলাপ— যার অধিকাংশ জুড়েই থাকেন জনৈক মিত্র-মহাশয়, যিনি অন্য একজন ফিল্ম ডিরেক্টর।
সেই মিত্র-মহাশয় বাঁকা পথে তাঁর সিনেমার জন্য প্রোডিউসার জোগাড় করেন, ঘুষ দিয়ে পুরস্কারের ব্যবস্থা করেন। আর আমাদের নাটকের পুরুষ চরিত্রটি কিছুই না করে উঠতে পারার হতাশায় গুমরে মরেন। নাটকের নারী-চরিত্রটি তাঁর ধর্ম পরিচয়ের কারণে পেশার জগতে পদোন্নতি পান না। একবিংশ শতাব্দীর ভারতবর্ষ তাঁদের সততা, মানবিকতা আর পরিশ্রমের মূল্য দিতে নারাজ।
নাটকের নাম ‘মিত্রকে নিয়ে কী করিতে হইবে’। বিখ্যাত মরাঠি নাট্যকার রাজীব নায়েকের নাটক, যা দেখায় কম, শোনায় কম, ভাবায় অনেক বেশি। এবং আদ্যন্ত সংলাপধর্মী হওয়া সত্ত্বেও একমুহূর্তের জন্যও মঞ্চ থেকে চোখ সরানো যায় না, তার জন্য দায়ী মূলত নারী চরিত্রে শ্রাবন্তী ভট্টাচার্যের অভিনয়। এর আগে তিতুমীরে ওঁর অভিনয় দেখেছিলাম, অ্যামেচারিস্ট লেগেছিল। ওয়েব সিরিজ বিরহীও দুর্বল চিত্রনাট্যের গুণে সম্ভবত তাঁকে ব্যবহার করতে পারেনি ঠিকঠাক। কিন্তু এই নাটকে টানা দু’ঘণ্টা তাঁর হাসি-কান্না, ভেঙে পড়া-উঠে দাঁড়ানো, দাপুটে অধ্যাপিকা থেকে আদুরে প্রেমিকায় রূপান্তর দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, বাংলার মঞ্চ সত্যিকারের ভাল অভিনেত্রীর যে অভাবটা বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে অনুভূত হচ্ছে, সেটা বুঝি এ বার পূরণ হতে চলল।
শুধু শ্রাবন্তীর অভিনয় দেখার জন্যই নাটকটা আর একবার দেখা যায়। আর নাটকের মুখ্য চরিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি অনুবাদ থেকে শুরু করে মঞ্চ হয়ে আলো পর্যন্ত সবটাই নিজের হাতে করা জয়রাজ ভট্টাচার্যের কথা না-বললেও চলে।
(২)
অনেকেই হয়তো জানেন না, ‘ন্যাশনাল মাইম ইন্সটিটিউট’ নামে একটি মূকাভিনয় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আছে সল্টলেকে। সেই কেন্দ্রের দোতলার একটি ব্ল্যাকবক্স থিয়েটারের মতো মাঝারি মাপের হলঘরে ওঁরা মাঝে মাঝে মূকাভিনয়ের শো করেন। দর্শকাসন বলে আলাদা কিছু নেই। হলেরই একদিকে খান কুড়ি চেয়ার পেতে দেন।
মূকাভিনয় মানে তো জানতাম সেই মুখে সাদাকালো রং করে, কালো পোশাক পরে অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে অভিনয়। সেদিন ওঁদের সেই হলঘরে বসেই দেখলাম এক অবিশ্বাস্য প্রোডাকশন— ‘লোককথা’। মূকাভিনয়ের মাধ্যমে বুনে তোলা দেড় ঘণ্টার এক নাটক। অথচ সেই মূকাভিনয়ের কালো পোশাক বা মুখে রং মাখার ব্যাপার নেই। বদলে অভিনেতারা অঙ্গভঙ্গির সঙ্গে মুখভঙ্গিও করছেন। পোশাকেও রয়েছে চরিত্রানুগ বৈচিত্র। মূকাভিনয়, থিয়েটার আর জিমন্যাস্টিককে মিশিয়ে এমন নতুন ধরনের পরীক্ষামূলক কাজ আগে কখনও হয়েছে বলে জানা নেই।
আর একপাল তরুণ-তরুণীর কী দুর্দান্ত পারফরম্যান্স। দড়ি বেয়ে অবলীলায় দশ পনেরো ফুট উপরে উঠে যাচ্ছেন, দোল খাচ্ছেন, আর সেই অবস্থাতেই যথাযথ মুখভঙ্গিতে অভিনয়ও করছেন, বসে থাকা অবস্থায় লাফ দিয়ে উঠে যাচ্ছেন চার ফুট উঁচু পাটাতনে, দ্রুতলয়ের ছন্দে বাজনার সঙ্গে দলবদ্ধ অভিনয়ে নিঁখুতভাবে বুনে তুলছেন একটা মনোরম কাহিনিকে। সঙ্গে রয়েছে অত্যন্ত সুপরিকল্পিত আলো আর আবহের কাজ। দেড় ঘণ্টার প্রযোজনায় দেড় মিনিটের জন্য অন্যমনস্ক হতে দেন না ওঁরা।
মাত্র জনা কুড়ি দর্শকের সামনে পরিবেশনের জন্য এত বিপুল পরিশ্রম, এত খরচ?
সত্যিকারের শিল্প আর সত্যিকারের সাধনা দুটোই বোধহয় এই রকম, যা স্রোতের বিরুদ্ধে চলে, নিজের মতো করে নিজের কথা বলে, দর্শক বা শ্রোতারা ফাঁকতালে যে যেটুকু পারেন দেখে-শুনে নেন। তাই না?
(ফিচার ছবি লেখকের ফেসবুক থেকে নেওয়া। লেখকের বক্তব্য নিজস্ব। লেখা পাঠাতে পারেন এই মেলে— sadakalonewz@gmail.com)