তুহিন সাজ্জাদ সেখ

ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন বা ইসরোর তত্ত্বাবধানে সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টার থেকে ১৪ জুলাই মহাশূন্যে পাড়ি দিয়েছে চন্দ্রযান–৩। ঘড়িতে তখন বেলা ২টো ৩৫ মিনিট ১৭ সেকেন্ড। ২৩ অগস্ট চাঁদের মাটিতে পা রাখবে ল্যান্ডার বিক্রম। তারপর চাঁদের বুকে ছোট ছোট পা ফেলে ঘুরে দেখবে রোভার প্রজ্ঞান। উদ্দেশ্য চাঁদের মাটি ও সেখানে মজুত অন্য উপাদানের নমুনা সংগ্রহ। এই অভিযান চাঁদকে আরও সঠিক ও গভীর ভাবে জানার জন্য!
চলতি বছরের ২৯ জুলাই আমেরিকার ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা নাসা, অ্যাপেলো-১১ চন্দ্রযান মিশনের সময় চাঁদে রোদ পোহানোর একটি ছবি প্রকাশ করে। সেই ছবি আজ থেকে প্রায় চুয়ান্ন বছর আগে চাঁদের বুকে প্রথম মানুষের পা রাখার স্মৃতি উস্কে দিয়েছে। সেদিন আমেরিকার পাঠানো চন্দ্রযান ‘লুনার মডিউল ঈগল’ চাঁদের মাটিতে অবতরণ করেছিল! নাসার ছবিতে দেখা যাচ্ছে, দীর্ঘ অন্ধকার ছায়া চন্দ্রপৃষ্ঠের প্রতিকৃতিটিকে চিহ্নিত করার সঙ্গে সঙ্গে উজ্জ্বল সূর্যের আলো জ্বলজ্বল করছে। এই ছবিটি চুয়ান্ন বছর আগে, ২০ জুলাই, ১৯৬৯ সালে তোলা। ছবিতে আরও নজর কাড়ে ‘লুনার-মডিউল ঈগল’ ও তার চালক নভোচারী এডউইন ‘বাজ’ অলড্রিন।
দিনটা ছিল ১৯৬১ সালের ২৫ মে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জন এফ. কেনেডি আমেরিকাবাসী তথা গোটা বিশ্বের সম্মুখে ঘোষণা করেছিলেন একটি যুগান্তকারী স্বপ্ন— চাঁদের মাটিতে মানুষের অবতরণ! নাসার হাত ধরে সাড়ম্বরে আয়োজিত হয়েছিল ‘অ্যাপোলো লুনার মিশন’। তারই এক দৃষ্টান্তমূলক সফল আয়োজন ছিল অ্যাপোলো—১১। লক্ষ্য ছিল চাঁদের বুকে মানুষের পায়ের ছাপ ফেলে আবার এই পৃথিবীর বুকে ফিরে আসা, চাঁদের মাটিতে চন্দ্রযান ঈগলের অবতরণ ও তার বৈজ্ঞানিক অন্বেষণ, চন্দ্রপৃষ্ঠে পৃথিবীর বুকে বার্তা-সংকেত পাঠানোর জন্য দূরদর্শন ক্যামেরার প্রতিস্থাপন, সৌর বায়ুর গঠনগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ভূকম্পন-সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ প্রভৃতি।
বুকভরা উচ্ছ্বাস ও চোখভরা স্বপ্ন নিয়ে ১৯৬৯ সালের ১৬ই জুলাই আমেরিকার কেপ কেনেডি থেকে মহাকাশযান অ্যাপোলো-১১ অধিনায়ক নভোচারী নীল আর্মস্ট্রংয়ের নেতৃত্বে, কমান্ড-মডিউল চালক নভোচারী মাইকেল কলিন্স্ এবং চন্দ্রযান লুনার-মডিউল চালক নভোচারী এডউইন ‘বাজ’ অলড্রিন চাঁদের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিয়েছিল।  ১৯৬৯ সালে ২০ জুলাই, যখন কম্যান্ড-মডিউল চালক নভোচারী মাইকেল কলিন্স্ কক্ষপথে ভাসমান মহাকাশযানে অপেক্ষা করছিলেন, ঠিক তখনই অধিনায়ক নীল আর্মস্ট্রং ও লুনার-মডিউল চালক নভোচারী এডউইন ‘বাজ’ অলড্রিনকে সঙ্গে নিয়ে প্রথম চাঁদের মাটিতে পা রেখেছিলেন। নীল আর্মস্ট্রং-এর চাঁদের মাটিতে পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে প্রথমবারের জন্য নীলগ্রহের মানবকুলের একজন ব্রহ্মাণ্ডের অন্য উপগ্রহের বুকে পদচিহ্ন আঁকার ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছিল! গোটা বিশ্বের প্রায় ৬৫০ মিলিয়ন মানুষ দূরদর্শনের পর্দায় চাঁদের মাটিতে দাঁড়িয়ে নীল আর্মস্ট্রং-এর ছবি দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তি, “….চাঁদের বুকে মানুষের ছোট্ট একটি পা, গোটা মানবজাতির জন্য একটি সুবিশাল পদক্ষেপ”। মানুষ শিহরিত হয়েছিল।
প্রকাশিত ছবিটিতে সেই যুগান্তকারী মিশনের লুনার-মডিউল ঈগল এবং মহাশূন্যে পরিধানযোগ্য ‘স্পেসসুইট’ পরা লুনার-মডিউল চালক মি. অলড্রিন। দেখা যাচ্ছে নভোচারী অলড্রিন একটি দীর্ঘ ধাতব চাদর উন্মোচন করেছেন চন্দ্রপৃষ্ঠে সূর্যের আলোকরশ্মির অভিমুখে। সৌর বায়ুর গঠনগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে। এই পরীক্ষার মাধ্যমে ওই অঞ্চলের মধ্যে প্রবাহিত সৌর বায়ুর উপাদানগত আচরণ এবং উপস্থিত আদর্শ গ্যাসগুলোর ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম সম্বন্ধে জানা যায়। তাই সূর্যের মুখোমুখি অ্যালুমিনিয়ামের ধাতব চাদরটি উন্মুক্ত করে ধরলে, চাদরে আটকে থাকা কণাগুলি সৌরবায়ুতে বাইরের দিকে প্রবাহিত হয় এবং চাদরের গায়ে সূর্য থেকে আগত উপাদানের নমুনা ধরে। বিজ্ঞানের পরিভাষায় একে সৌরবায়ু সংগ্রাহকও বলা হয়ে থাকে।
১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জুলাই, সফলভাবেই নীল আর্মস্ট্রং ও তাঁর সঙ্গীরা পৃথিবীর বুকে ফিরে এসেছিলেন। চাঁদের পাথর, মাটির নমুনা এবং সৌর বায়ু সংগ্রাহককেও পরীক্ষাগারে বিশ্লেষণের জন্য ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। পরীক্ষালব্ধ এই সব তথ্য আমাদের মহাকাশীয় উপাদান সংশ্লেষণের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক তত্ত্ব বিশ্লেষণে সহায়তা করে, সৌরজগতের উৎস সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা তৈরি হয়, গ্রহের বায়ুমণ্ডলের ইতিহাস জানতে পারি এবং সৌর বায়ুর গতিবিদ্যা বিষয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ধারনার জন্ম দেয়।
আজ থেকে প্রায় চুয়ান্ন বছর আগে, গ্রিনিচ মিন টাইম অনুযায়ী ২টো বেজে ৫৬ মিনিটে চাঁদের ‘সি অব ট্রাঙ্ক্যুইলিটি’ অঞ্চলে অ্যাপোলো-১১-এর সফল অবতরণের পরে আমেরিকা তথা সারা বিশ্বের সম্মুখে চাঁদের উপর এক অদ্ভুত দখলদারিত্ব জন্ম নিয়েছে। এখন ভারতও সেই দখলদারিত্বের অংশীদার।

(ফিচার ছবি ইন্টারনেট থেকে নেওয়া। লেখকের বক্তব্য নিজস্ব। লেখা পাঠাতে পারেন এই মেলে— sadakalonewz@gmail.com)