অনিমেষ বৈশ্য

দাসদাকে নাকি একবার তাড়া করেছিলেন বিশ্বখ্যাত ফুটবলার বেকেনবাওয়ার। শোভাবাজারের অলিতেগলিতে নয়, সুদূর জার্মানিতে। এই তাড়া খাওয়ার গল্প বেশ গর্ব করে বলতেন দাসদা। বিশুদ্ধ উত্তর কলকাতার উচ্চারণে। যে-সে লোক তো নয়, তাড়া করেছেন স্বয়ং বেকেনবাওয়ার। গর্বেরই কথা। এখন হলে হয়তো মোবাইলে কেউ ভিডিও তুলে রাখত। লম্বা-চওড়া চেহারার দাসদা ছুটছেন। পিছনে বেকেনবাওয়ার। ফেসবুকে ভাইরাল হতে বড় জোর এক মিনিট লাগত।
শোভাবাজারের গোবিন্দচন্দ্র দাস ওরফে জিসি দাস ওরফে দাসদাকে বেকেনবাওয়ার কেন তাড়া করেছিলেন আমি জানি না। তবে গল্পটি অমর হয়ে আছে। দাসদা ছিলেন ব্যবসায়ী এবং খেলাপাগল। বিশ্বের নানা দেশে ঘুরে বেড়াতেন। এবং খেলার খবর সংগ্রহ করতেন। বেকেনবাওয়ার, মারাদোনা, লোথার ম্যাথাউজের খুঁটিনাটি খবর বাঙালি প্রথম জেনেছে আজকাল-এর খেলা পত্রিকা মারফত। বিশ্বকে বাঙালির দুয়ারে আনার ভগীরথ ছিলেন দাসদা। আমি আজকাল পত্রিকার ক্রীড়া বিভাগে কিছুদিন কাজ করেছিলাম। সেই সূত্রেই দাসদার সঙ্গে আলাপ।
তখন ইন্টারনেট নেই। ফুটবলে বাঙালির বিশ্বরূপ দর্শন হয়েছিল দাসদা মারফত। জিসি দাসের লেখা মানেই ক্লিনসম্যানের বাড়ির জানলা দেখে আসা। তিনি ছিলেন প্রাক-অন্তর্জাল যুগের আমাদের জানলা। পশ্চিমের হাওয়া সেই জানলা দিয়ে হু হু করে বইত। দাসদা কত গল্প করতেন। অবাক হয়ে ভাবতাম আমার সামনে যে-ভদ্রলোক বসে, তিনি মালদিনি অথবা প্লাতিনির বাড়ির উঠোন দেখেছেন। কারও সঙ্গে কথাও বলেছেন। দু-একটা বিদেশি ভাষা একটু-আধটু জানতেন দাসদা। তার প্রমাণ পেতাম তিনি যখন টেলিফোনে বিদেশে কথা বলতেন আমার পাশে বসেই।
টেলিফোন অপারেটরকে বলতেন ইতালি বা জার্মানির অমুক জায়গায় ধরে দিন তো। আমি অবাক হতাম। আমি তো মেদিনীপুর কিংবা বগুলার থেকে বেশি দূরে জীবনে কাউকে ফোন করিনি। কিন্তু এই লোকটা জার্মানি, ফ্রান্স বা স্পেনে ফোন করে কার সঙ্গে কথা বলেন? একটা কথা তিনি প্রথমেই বলতেন, ‘ইউভোলিঅজি রেজুলতাতি?’ (উচ্চারণটা হয়তো ভুল করলাম।) এটা কী ভাষা আমি জানি না। একদিন বলেই ফেললাম, ‘ও দাসদা, এই কথার মানে কী?’ দাসদা ঘনাদার মতো মুচকি হেসে বলতেন, ‘এর মানে হল, খেলার রেজাল্ট কী?’ কিছুক্ষণ কথা বলেই তিনি কত খবর লিখে ফেলতেন। ফোন রাখার আগে বলতেন, ‘চিয়াও।’ আমি একদিন বললাম, ‘চিয়াও মানে কী?’ দাসদা বললেন, ‘বিদায়।’
গত ৫ অগস্ট সকালে শুনলাম দাসদা আর নেই। বয়স হয়েছিল ৮৭। আমি জানি, বিশ্বের কোনও ফুটবলারই দাসদার জন্য অশ্রুপাত করবেন না। কিন্তু খবরের কাগজের খেলার পাতাটা দিন কতক খুব পানসে লাগবে। আজ আর বেকেনবাওয়ার নয়, আমরাই আপনাকে তাড়া করব। দু-একটা গল্প শুনিয়ে যান দাসদা। মারাদোনার গল্প, পেলের গল্প। আপনার গায়ে ফেসবুক-টুইটারের গন্ধ নেই। বরং তেরো নদীর পাড়ের গন্ধ আছে। এই গন্ধ যে কতকাল পাইনি।
বিদায় বলব, নাকি চিয়াও?
থাক, সুতানুটির দাসদাকে কিছুই বললাম না। ওসব বলতে বাধে খুব।

(ফিচার ছবি ইন্টারনেট থেকে নেওয়া। লেখকের বক্তব্য নিজস্ব। লেখা পাঠাতে পারেন এই মেলে— sadakalonewz@gmail.com)