সায়ন্তন সেন

আমি স্বপ্নদীপকে দেখেছিলাম বড়োজোর মিনিট পাঁচেক। যাদবপুরে অ্যাডমিশন টেস্ট দিয়ে সে তখন বাড়ি ফিরে যাবে, তার আগে চারের গেটের আশপাশে ইতিউতি চেয়ে কিছু খুঁজছে। একই সঙ্গে আমরা রাস্তা পেরোলাম। স্বপ্নদীপের বাবা বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন, যাদবপুরে আমার যাতায়াত আছে। নেপালদার দোকানের সামনে এসে নরম হয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘এখানে খাবার হোটেল কোথায় আছে বলতে পারবে ভাই?’ পাশেই লাজুক ছেলেটি দাঁড়িয়ে। আমি যতই নিকটবর্তী লঙ্গরখানাগুলির খাদ্যতালিকা বলে যাই, সে করুণ চোখে বাপের দিকে চেয়ে স-সম্ভ্রমে একের-পর-এক নাকচ করে দেয়। মহা জ্বালা! একটু তদন্ত ক’রে বুঝতে পারলাম, চাউমিন খেতে চায়। সঙ্গত দাবি। অর্থাৎ, প্রথমবার যাদবপুরে এসে ফিরে যাওয়ার আগে, বিশেষত অ্যাডমিশন টেস্টের গুঁতো সামলে উঠে, ডাল-ভাত অথবা এগ টোস্ট তার পছন্দ নয়। কাকু কিন্তু ডাল-ভাতেরই পক্ষে। আমি একটু জোর খাটিয়েই বললাম, ‘চাউমিন অনেক খাবে। (জামাইয়ের দোকানের দিকে দেখিয়ে) ইউনিভার্সিটিতে এলে তখন কিন্তু প্রায়দিন এখানেই খেতে হবে। বরং আজকেই টেস্ট করে যাও।’ একটু হেসে, বাবার, আর বোধহয় আমার মুখ চেয়েও, ছেলেটি রাজি হয়ে গেল। তারপর জানলাম, ওর নাম ‘স্বপ্নদীপ’। স্বপ্নদীপ যখন খাচ্ছে, একটু দূরে দাঁড়িয়ে আমি আর আমার বন্ধু কাকুর সঙ্গে কথা বলছিলাম। কাকু বলছিলেন, স্বপ্নদীপ এঞ্জিনিয়ারিং পড়বে— এরকমটাই বাড়িতে ঠিক হয়ে ছিল। তবু যাদবপুরের বাংলা প্রবেশিকায় সে একটিবার বসতে চেয়েছে। যাদবপুরে লেগে গেলে বাংলাটাই পড়বে স্বপ্নদীপ, এই আবদার। আর যদি চান্স না পায় এখানে, তাহলে বাবা-মা’র এঞ্জিনিয়ারিং-ই সই! কাকু বলছিলেন, ‘ও একটু এই সব ভালোবাসে’, ‘এটা ওর একটা ভালোবাসার জায়গা’, ‘নিজের পছন্দ’,… ইত্যাদি। ‘এই সব’ মানে, গান-গল্প-সিনেমা— এই সব। স্বপ্নদীপ তাই একবার অ্যাডমিশন টেস্টে নিজেকে আঁচিয়ে নিতে চেয়েছিল। স্বপ্নদীপের পরীক্ষা দিতে আসার গল্প আমি এটুকুই জানি।
বোধহয় ভুলেও যেতাম, যদি স্বপ্নদীপ বেঁচে থাকত। হাজার হাজার ছেলেমেয়ে ফি বছর সাহিত্য ভালোবেসে পরীক্ষা দিতে আসে যাদবপুরে। পড়ার সুযোগও পায়। অনেকেরই গল্প অবিকল স্বপ্নদীপের মতো। তাদের কেউ কেউ, স্বপ্নদীপের মতোই, মেইন হস্টেলে থাকে। প্রায়শই তিন দিনের বেশি তারা টিকেও যায় দেখি যাদবপুরে। প্রাণের মায়া তো আর সহজে কাটে না! শুধু স্বপ্নদীপ পারল না। স্বপদীপদের, অর্থাৎ মেইন হোস্টেলে ফার্স্ট ইয়ারের (বিশেষত, আর্টস ফ্যাকাল্টির) যে ছাত্ররা কোনও ‘দাদা’ অথবা দাদাস্থানীয়ের সুপারিশ ছাড়াই থাকতে আসে তাদের সঙ্গে এখানকার ‘দাদা’রা কী রকম আচরণ করেন, তার বিবরণ এখন প্রকাশ্যে আসছে। সবটাই ফেসবুকে। সেগুলো পড়লে গা গুলিয়ে ওঠে। তার থেকে বেশ অনুমান করতে পারছি, স্বপ্নদীপ কী ভাবে মারা গেছে। অবশ্য এখন সকলে বলছে বলে নয়, যাদবপুর মেইন হস্টেলের চরিত্র সম্পর্কে আমার আগে থেকেই ধারণা ছিল। আমরা যখন এমএ ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র, তখন আমাদেরই এক বন্ধুকে যাদবপুর থানার সামনে থেকে হস্টেলের ছাদে তুলে নিয়ে যায় হস্টেল-গুণ্ডাদের একটা দল। মেরে তার গাল, কপাল ফাটিয়ে দেয়। জামা-প্যান্ট খুলে নেয়। প্রায় ঘণ্টাখানেক তার সঙ্গে বন্ধ ছাদে এই নিষ্ঠুর তামাশা চলে। যারা খবর পেয়ে ছুটে গিয়েছিল, তাদের মধ্যে একজনকে চিনি যে হস্টেলের দরজায় সেদিন একটা পাথর ছুড়েছিল (আমি চাই আবার হস্টেলের দরজায় পাথর পড়ুক)। তখন শুনেছিলাম, এই হস্টেল-গুণ্ডাদের সকলে যাদবপুরের ছাত্র নয়। হস্টেলে তারা এঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের কোন্ এক ছাত্রনেতার আশ্রিত। আর আশ্রিতদের দাপট নাকি সবচেয়ে বেশি। হস্টেলের ভেতর সব বাঘের বাচ্চা। বাদবাকি যাদবপুরেরই সায়েন্স আর এঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র। আবার অনেকে প্রাক্তন ছাত্র, কিন্তু হস্টেল ছেড়ে নড়বার নাম নেই। নানা কারণে এরা নিজেদের বাঘের বাচ্চা বলে মনে করে। ‘সিনিয়র’ বলে তো বটেই, আবার নেতা বলেও। কিছুদিন আগেও এবিভিপির গুণ্ডারা হস্টেলের এই সব ছাত্রনেতাদের ঘরে থেকে হস্টেলে রাজত্ব করত। আমার বন্ধু যে মার খেয়েছিল সেই চার-পাঁচ বছর আগে, তার কোনও প্রতিকার হয়নি। বন্ধ ছাদে, তার গণপিটুনির কার্নিভালে হস্টেলের অনেকেই অংশ নিয়েছিল। দরকার ছিল তাদের প্রত্যেককে চিহ্নিত করা। দরকার ছিল প্রত্যেকের বিরুদ্ধে কড়া আইনি ব্যবস্থা নেওয়া। কিচ্ছু হয়নি।
স্বপদীপের মৃত্যুর পরে কিছু হবে কিনা জানি না। আমি শুধু এটুকু বলতে পারি: যারা স্বপ্নদীপের মৃত্যুর জন্যে দায়ী, আমি চাই তাদের জেল হোক। হিংস্র জন্তুদের যেমন খাঁচায় রাখা হয়, তেমনি। যা হয় হোক, কিন্তু স্বপ্নদীপের মৃত্যুর পরে এই মৌরসিপাট্টা আর চলতে পারে না। স্বপ্নদীপের রক্তের দাম যাদবপুরে কতটুকু, সেটা যাদবপুরকেই প্রমাণ করতে হবে। আমি চাই সকলে ভাবতে চেষ্টা করুন, কতখানি লাঞ্ছিত হয়ে স্বপ্নদীপ আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকতে পারে। উৎপীড়ন কতটা অ-সহ্য মনে হলে, ফুটফুটে একটা ছেলে, যে ভালোবেসে যাদবপুরে পড়তে এসেছে, ভালোবেসে ক্লাসে বসেছে, সহপাঠীদের সঙ্গে বন্ধু পাতিয়েছে, সে তিন দিনের মাথায় ছাদ থেকে ঝাঁপ দেওয়ার কথা ভাবে। অবশ্য, স্বপ্নদীপ নিজে থেকে ঝাঁপ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কিনা, তাও বলা মুস্কিল। হতেই পারে, এটা হস্টেলের দাদাদেরই ফূর্তির শেষ ধাপ। ‘এবার ঝাঁপ দে’—  তারাও এরকম নির্দেশ দিয়ে থাকতে পারে। এমনকী তাকে কেউ ধাক্কা মেরে ছাদ থেকে ফেলে দিলেও আমি আশ্চর্য হব না। কিন্তু যদি তা না হয়, যদি আত্মহত্যাই করে থাকে স্বপ্নদীপ, তাহলে কার কোন্ দোষটা কমে যায়?
এখন আমরা জানতে পারছি: হোস্টেলের ‘দাদা’রা নিয়মিত ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রদের শরীরে নানা উপায়ে নির্যাতন করে। এই নির্যাতন মুখ্যত মলেস্টেশন বা সেক্সুয়াল অ্যাসল্ট। ‘দাদা’রা ফার্স্ট ইয়ারদের জামা-কাপড় খুলে নেয়। যৌনাঙ্গের দৈর্ঘ্য মাপে। তার সঙ্গে চলে হাত দিয়ে, লাঠি দিয়ে, কঞ্চি দিয়ে খোঁচা, মারধোর। আমি চাই সকলে ভাবুন, এই প্র্যাকটিস আসলে যে-কোনও ‘স্লেভ সোসাইটি’র মতো। এখানে ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেদের দিয়ে সিনিয়র দাদারা ইচ্ছে মতো জল ভরিয়ে, গাঁজা ডলিয়ে নেয়। ইচ্ছে মতো তাদের পরিচ্ছদ ও চুলের ছাঁট নিয়ন্ত্রণ করে। ইচ্ছে মতো পিটিয়ে-গুঁতিয়ে-খুঁচিয়ে হাতের সুখ করে। সঙ্গে চলে নিছক আমোদের জন্য লাগাতার যৌন-উৎপীড়ন। অর্থাৎ, হস্টেলে সদ্য-আসা ছেলেদের এরা মনে করে নিজের ‘সম্পত্তি’। ‘আমার পাঁঠা আমি ল্যাজে কাটব না মাথায় কাটব সেটা আমার ব্যাপার’, দাদারা চলে এই মনোভঙ্গিতে। একে দাসপ্রথার সঙ্গে তুলনা করায় কোথাও ভুল নেই। এবং এটাই যাদবপুর মেইন হোস্টেলের কালচার— কথাটা আমি জোর দিয়ে বলছি। যদি তা না হত, তাহলে যারা প্রত্যক্ষ ভাবে এই ‘দাদাগিরি’, এই যৌন-উৎপীড়নের বীভৎসতার সঙ্গে যুক্ত নয়, তারা অন্তত এর প্রতিবাদ করত! আরও অনেক আগে থেকেই প্রতিবাদ করত! আমি ধরে নিচ্ছি, আমি প্রাণপণে বিশ্বাস করছি, হস্টেলের সব আবাসিক এরকম হিংস্র, ধর্ষকামী নয়। আমি ধরে নিচ্ছি, হস্টেলের অনেক আবাসিক এরকম হিংস্র, ধর্ষকামী নয়। কিন্তু, তারা কেউ প্রতিবাদীও তো নয়। এমনকি, বেশিরভাগ সত্যবাদীও নয়। যদি তারা প্রতিবাদী হত, তাহলে তো স্বপ্নদীপ মরে যেত না। যদি তারা সত্যবাদী হত, তাহলে স্বপ্নদীপের খুনীরা সঙ্গে-সঙ্গে ধরা পড়ত। এতক্ষণে তারা লক্ আপে থাকত। এসব কিছুই হয়নি। তার কারণ, মেইন হস্টেলের একটা বড়ো অংশ এই স্লেভ সোসাইটিকে সমর্থন করে। হয়তো তাদেরও এতে কিছু সুবিধে হয়। তারাও নিশ্চয়ই মনে করে, এখানে দুধের শিশুদের ‘লৌহমানব’ হয়ে ওঠার ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে। মর্দাঙ্গি শেখানো হচ্ছে। সেটা খারাপ কিছু নয়। পৌরুষের মানদণ্ড হচ্ছে ধর্ষকাম চরিতার্থ করবার ক্ষমতা। পুংদণ্ডের মাপ। এই ট্রেনিংয়ের মধ্যে দিয়ে প্রতি বছর নতুন কিছু বাঘের বাচ্চা, অর্থাৎ সম্ভাব্য-ধর্ষক তৈরি হয়। ঠিক আর্মি ট্রেনিং-এর মতো। যারা হয় না? তারা কোনওক্রমে বেঁচে থাকে, গুটিয়ে, কুঁকড়ে, ভয়ে কাঁপতে-কাঁপতে। অথবা তারা পালায়।  স্বপ্নদীপ পালাতে পারলে এ যাত্রা বেঁচে যেত। কিন্তু বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে পালানোর সময় ও সুযোগ সে পায়নি।
স্বপদীপের মৃত্যু কি নিবার্য ছিল না? যারা স্বপ্নদীপের মৃত্যুর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত নয়, ও যে মরে যেতে পারে, তারা কি বুঝতেই পারেনি (আমার তো মনে হয়, আরও অনেকে যে দাঁতে-দাঁত-চেপে বেঁচে আছে, সেটাই আশ্চর্য)? বুঝতে নিশ্চয় সকলেই পেরেছিল। বুঝতে পারার পরেও তাদের একজনও কি প্রতিবাদ করেনি? হয়তো করেছে। হয়তো তারা বড়োই সংখ্যালঘু। হয়তো তারা ভিড়ের বিরুদ্ধে জোরে কথা বলতে ভয় পেয়েছে। হয়তো তারা মেনে নিয়েছে, হস্টেলে থাকলে, দাদাদের চোব্য চোষ্য হয়ে থাকতে হবে, এটাই চিরকালের নিয়ম। হয়তো তাদের গায়েও এই নিয়মের চিহ্ন আছে। হয়তো তারা এই হনন উৎসব থেকে দূরে থেকেছে। উদাসীন থাকতে চেয়েছে। আমি জানি না, স্বপ্নদীপের মৃত্যুর ঘণ্টাখানেক আগে মেইন হোস্টেলের একজনও নিজেকে অপরাধী মনে করেছিল কিনা। স্বপ্নদীপের মৃত্যু ঠেকানো যায়নি। এটা গোটা হস্টেলের দায়। আমি বিশ্বাস করি না, বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ হস্টেলের এই চরিত্র সম্পর্কে কিছু জানেন না। কিন্তু কতৃপক্ষ ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রদের ক্যাম্পাসের ভিতরে আলাদা একটা ছাত্রাবাসে রাখার ব্যবস্থা করে উঠতে পারেন না। কেন পারেন না জিগ্যেস করলে এখন তার হাজারটা কারণ বেরোবে। যেন সেই সব কারণ, সেই সব খুচরো অসুবিধা, স্বপ্নদীপের প্রাণের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ! স্বপ্নদীপ এই সিস্টেমিক ভায়োলেন্সের শিকার। মৃত্যুর আগে হস্টেলের ধর্ষক দাদারা তার সঙ্গে কী আচরণ করেছিল জানি না। দু-একটা সম্ভাবনার কথা মনে এলে শিউরে উঠি।
আমাকে কোনও পরিস্থিতিতে কেউ জামা কাপড় খুলতে বাধ্য করছে, এ আমি কল্পনাও করতে পারি না। শুনেছি স্বপ্নদীপের দেহ পাওয়া গেছে উলঙ্গ অবস্থায়। নিশ্চয়ই সে নিজেই নিজের জামাকাপড় খুলে ফেলেনি। তাকে এমনটা করতে বাধ্য করা হয়েছিল। শুনেছি, স্বপ্নদীপের শরীরে একাধিক আঘাতের চিহ্ন আছে, যার সবগুলো ছাদ থেকে পড়ে নাও হতে পারে। তার মানে, জামাকাপড় খুলিয়ে স্বপ্নদীপকে মারধর করা হয়েছিল। সেই মারধরের মাত্রা কতদূর চড়েছিল জানি না। সঙ্গে নিশ্চয়ই ছিল নানা রকম হুল ফোটানো কথা, টিটকিরি, মস্করা, ধমক, হুমকি। জানি না, সে গ্রাম থেকে কলকাতা এসেছে বলে, বাংলা নিয়ে পড়ছে বলে, এঞ্জিনিয়ারিং-এর দাদারা একটু বেশি উৎসাহিত হয়েছিল কিনা। অথবা হতে পারে, তার শান্ত স্বভাব, নরম শরীর দাদাদের আরও বেশি উত্তেজিত করে তুলেছিল। তার শরীরের সব খাঁজ ভাঁজ পরখ করে নিতে আরও বেশি প্ররোচনা দিয়েছিল। তার গায়ে সিগারেটের ছ্যাঁকা দিতে আরও বেশি উসকেছিল। জানি না, শেষে দাদারা তাকে ঝাঁপ দিতে বাধ্য করে, নাকি ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। ধর্ষকামী মানুষের পক্ষে সব সম্ভব। যদি স্বপ্নদীপ খুন হয়ে থাকে, তাহলে তাকে খুন করা হয়েছে তারিয়ে তারিয়ে। তারপর ঠাণ্ডা মাথায় প্রমাণ লোপাট করা হয়েছে। কী ভাবে, কত ব্যথা স্বপ্নদীপ পেয়েছিল, জানার কোনও উপায় সে রাখেনি। এখন সে নীরব। তবু আমাদের ভেবে নিতে পারা উচিত। হস্টেল থেকে মাকে ফোন করে সে বলেছিল ‘আমি ভালো নেই। তোমরা চলে এস’। তারপর আর একটাই দিন বোধহয় বেঁচে ছিল।
স্বপ্নদীপকে মরতে হল কারণ যাদবপুরে তার জীবন খুবই সস্তা। কথাটা শুনতে খারাপ, কিন্তু সত্যি। যদি তা না হত, তাহলে যাদবপুরের হস্টেলে এই বর্বর প্রথা সবার চোখের সামনে এভাবে চলতে পারত না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কথা আমি ছেড়ে দিচ্ছি। একটা হস্টেলে রোজ জুলুমবাজি হচ্ছে, মারধোর হচ্ছে, যৌন নিগ্রহ হচ্ছে, অথচ এর বিরুদ্ধে থাকা ছাত্ররা সংঘবদ্ধ হয়ে তার প্রতিবাদ করছে না? নাকি কেউ এসবের বিরুদ্ধে নয়? ‘ইন্ট্রো’ চাওয়া, ন্যাংটো করে হাঁটুর পিছনে কঞ্চির খোঁচা— সব এতটাই স্বাভাবিক? এতটাই সহজ? কারো গা গোলায় না? কারো একটা ঢিল ছুড়তে ইচ্ছে করে না? যারা এই নিপীড়নের শিকার তাদের কথা আমি বলছি না। তারা তো সন্ত্রাসের রাজত্বে চার আনা নিরাপত্তা মুঠোয় নিয়ে কোনও রকমে কুঁকড়ে বেঁচে থাকে। কিন্তু বড়রা? যাদবপুরে এসে তিন, চার, পাঁচ বছর পড়ার পরেও যে ছাত্র চোখের সামনে এই নারকীয় দৃশ্যমালা দেখে নীরব থাকতে পারে, হস্টেলে না থেকে তারও উচিত অপরাধীদের সঙ্গে সংশোধনাগারে থাকা।
জানি স্বপ্নদীপ মরে না গেলে এ সব কথা উঠত না। যা চলছে তাই চলত। স্বপ্নদীপ মরে গেছে। এখন আমাদের প্রমাণ করতে হবে, তার জীবনের কানাকড়ি মূল্য আমাদের কাছে আছে কিনা। থাকলে যারা অপরাধী, তাদের প্রত্যেককে চিহ্নিত করা হবে। প্রত্যেকের জেল হবে। হস্টেলের দাদাদের এই মৌরসিপাট্টা আজ, এখনই ভাঙবে। দরকার হলে আমাদের শিক্ষিকা-শিক্ষকেরা হস্টেলে গিয়ে রোজ ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলবেন। দরকার হলে আলাদা করে সেন্সিটাইজ়েশন প্রোগ্রামের ব্যবস্থা করতে হবে। আচরণবিধি শেখাতে হবে। সহবত শেখাতে হবে। তার জন্য গোটা হস্টেলটাকে আপাতত সংশোধনাগার বানিয়ে রাখা হোক, অথবা রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার। যাদবপুরের মেইন হস্টেল কিছু রোম সাম্রাজ্য নয়, চাইলে সকালে ঘোষণা করে বিকেলে সিজ় করে দেওয়া যায়। না-হয় কিছুদিন লেখাপড়া বন্ধ থাক। আগে হস্টেলের ‘দাদা’রা সুস্থ হোক, সভ্য হোক, মানুষ হোক। আগে বন্ধ হোক হস্টেলে লুম্পেনদের উপদ্রব। এই দাসপ্রথার অবসান হোক। কেমন করে তা হবে আমি জানি না। কিন্তু এগুলোই আগে হোক, তারপর লেখাপড়া হবে। তা না হলে স্বপ্নদীপকে যারা মারল, তারাই জিতবে।

(ফিচার ছবি ইন্টারনেট থেকে নেওয়া। লেখক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া। লেখকের বক্তব্য নিজস্ব। লেখা পাঠাতে পারেন এই মেলে— sadakalonewz@gmail.com)